বিশেষ প্রতিবেদন

নির্দেশ অমান্য করে ধ্বংস করা হচ্ছে ভিতরগড়ের প্রত্নসম্পদ

উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে পঞ্চগড়ের ভিতরগড়ের প্রাচীন দূর্গনগরীর মূল্যবান প্রত্নসম্পদ ধ্বংস করে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। অনেকে প্রত্নসম্পদ মাটি দিয়ে ঢেকে সেখানে স্থায়ী চা বাগান করছেন। এসব প্রাচীন স্থাপনা দেখাশোনা করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের প্রতি উচ্চ আদালতের আদেশ রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে উচ্চ আদালতের সেই নিদের্শনা বাস্তবায়নে মাথাব্যথা নেই সংশ্লিষ্টদের। এতে জনগুরুত্বপূর্ণ এই দূর্গনগরীর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাত থেকে প্রাচীন এই দূর্গনগরী রক্ষা এবং সরকারিভাবে ভিতরগড়কে প্রত্নস্থল এলাকা ঘোষণার জন্য ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ এর পক্ষে ২০১১ সালের ১৪ জুন হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস রক্ষা করতে ভিতরগর দূর্গনগরীকে প্রত্নতত্ত্ব স্থল ঘোষণা এবং মনিটরিং করতে রুল জারি করেন আদালত। কিন্তু আদালতের আদেশের পর ভিতগড়ে চলতে থাকে ধ্বংশলীলা। এরপর আবারও একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল উচ্চ আদালত কর্তৃক একটি জাজমেন্ট প্রদান করা হয়। উক্ত জাজমেন্টে ২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভিতরগড় দূর্গনগরী এলাকায় সব রকম অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ ও স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি সেখানকার প্রত্নতত্ত্বসম্পদ ধ্বংসাত্মক কার্জক্রম দেখাশোনা (মনিটরিং) করার জন্য পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়।এদিকে দূর্গনগরীর সার্বিক পরিস্থিতি সংশ্লিষ্টদের নজরে আনতে আগামী ১৯ মার্চ ভিতরগড় দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য শুরু হয়েছে নানা ধরনের প্রস্তুতি। এ উপলক্ষে আগামী ১৭ মার্চ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। সরেজমিনে ভিতরগড় প্রত্নস্থল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে দূর্গনগরীর আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদ। ভিতরগড় মহারাজা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে স্থানীয় এক প্রভাবশালী আবিষ্কৃত একটি প্রাচীন স্থাপনা মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলেছেন। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পেশীশক্তি বলে তিনি প্রাচীন প্রত্নসম্পদ ধ্বংস করে সেখানে চা বাগান লাগিয়েছেন। ২০১৩ সালে এই স্থাপনাটি আবিষ্কার করা হয়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার বাগানের ছবি এবং বক্তব্য নিতে গেলে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন। তার প্রতিবেশীও আবিষ্কৃত ওই স্থাপনার পূর্ব দিকে আরেকটি প্রত্নতত্ত্বসম্পদ ধ্বংস করে পাকা বাড়ি নির্মাণ করেন। অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের মনিটরিং না থাকায় এদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। তারা অবলীলায় প্রচীন ইতিহাস ধ্বংস করেই চলেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পঞ্চগড়ের ভিতরগড় প্রত্নস্থল দেশের অন্য সকল প্রাচীন দুর্গনগরীর মধ্যে সর্ববৃহৎ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি প্রত্নসম্পদ। প্রায় ১৫শ বছর আগে ভিতরগড়ে পৃথুরাজার রাজধানী ছিল এটি। পঞ্চগড় জেলা শহর হতে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে ২৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই দূর্গনগরীর অবস্থান। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৩২টি দেশ তাদের পর্যটন শিল্পকে আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার করছে। চীনের প্রাচীরের চেয়ে ভিতরগড়ের প্রাচীরের ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ। ভিতরগড় দূর্গনগরী মূলত চারটি বেষ্টনীর সমন্বয়ে গঠিত। এই বেষ্টনীসমূহ একটি অপরটির ভেতরে অবস্থিত। ভেতরের দুইটি বেষ্টনী সম্পূর্ণরূপে ইট দিয়ে বানানো এবং বাইরের বেষ্টনী দুটি মাটি দিয়ে তৈরি। তবে গুরুত্ব বিচারে তৃতীয় বেষ্টনীর কিছু স্থানে ইট ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি বেষ্টনী আবার বাইরের দিকে পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। এছাড়া ভিতরগড়ে মহারাজা দীঘিসহ মোট ১০টি ছোটবড় দীঘি আছে। অন্যদিকে মহারাজার দীঘির পাড়গুলো ইট দিয়ে বাধাই করা। যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল এবং অদ্বিতীয়। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এর সহকারী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. শাহনাজ হোসনে জাহান প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ভিতরগড় দুর্গ নগরীতে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খনন কাজ শুরু করেন। তিনি জাপান, কোরিয়া, আমেরিকা, ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ ১৮টি দেশে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। ইউল্যাবের `এক্সপেরিয়েন্সিং দ্য পাস্ট’’ শীর্ষক কোর্সের অধীনে পাঠরত শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় গত ৭ বছর ধরে খনন কাজ পরিচালনা করছেন তিনি। দীর্ঘ খননে এই দূর্গনগরী থেকে ইতোমধ্যে ১৪ বা ১৫শ বছর আগের বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ বা স্তুপ ও মন্দির আবিষ্কার করেছেন। ড. হোসনে জাহানের মতে,  ৬ষ্ঠ বা ৭ম শতকে নির্মিত এই দূর্গ নগরীতে ছিল সার্বভৌম প্রশাসন। গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন বাণিজ্য পথের ওপর তৈরি এই দুর্গনগরীর সঙ্গে সিকিম, তিব্বত, ভুটান, চীন, নেপাল, বিহার, পশ্চিববঙ্গ ও পুন্ড্রবর্ধনের বাণিজ্য ছিল। সড়ক ও নদী পথে ছিল এসব এলাকার যোগাযোগ ভালো। আসাম, কোচবিহার, ময়নামতি, পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড়ে আবিষ্কৃত প্রত্নতত্ত্বের বিভিন্ন নমুনার সঙ্গে এখানে প্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্বের কোন মিল নেই। চারটি দেয়াল দিয়ে এই নগরীকে সুরক্ষিত করা হয়। এর মধ্যে বাইরের দুইটি গড় বা দেয়াল মাটি দিয়ে তৈরি এবং সামনে পরিখা আছে। ভেতরের দুইটি দেয়াল ইটের তৈরি। এ পর্যন্ত এই দূর্গ নগরীতে স্তুপ ও মন্দিরসহ ১২টি প্রাচীন স্থাপনা আবিষ্কার করা হয়েছে। খনন কাজ পরিচালনাকালে তিনি ওই এলাকার মানুষকে সংশিষ্ট বিষয় অবগত করতে লোকনাট্য, সভা সেমিনার করে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। দূর্গ নগরীরর প্রাচীন স্থাপনা আবিষ্কারের খবরে জেলা এবং জেলার বাইরের অনেক পর্যটক নিয়মিত পরিদর্শন করেন।তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে ভিতরগড়ের প্রাচীন দূর্গ নগরীর মহা মূল্যবান প্রত্নসম্পদ প্রতিদিন ধ্বংস করা হচ্ছে। ২০১৩ সালে হাইকোর্টের একটি জাজমেন্টে ভিতরগড় দূর্গনগরীর প্রত্নসম্পদ রক্ষার্থে এলাকার মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। একই সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালকে ২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভিতরগড় দূর্গনগরীকে প্রত্নতত্ত্বস্থল ঘোষণা এবং পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সদর থানার অফিসার ইনচার্জসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি প্রাচীন এই দূর্গনগরী মনিটরিং করতে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে স্থানীয় অনেকেই প্রাচীন এই জনগুরুত্বপূর্ণ প্রত্নসম্পদ নির্বিচারে ধ্বংস করে যাচ্ছে।এসএস/পিআর