নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের প্রথম দোতলা স্টেশন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন। সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্রিটিশ আমলের এ স্থাপত্যের মূল ভবনের জায়গায় জায়গায় পরগাছা জন্মেছে। সিঁড়ি ও দেওয়ালের অবস্থায়ও বেহাল। মূল ভবনের সিঁড়িতে পর্যাপ্ত আলোর অভাবে আতঙ্কে ওঠানামা করতে হয় যাত্রীদের। দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্মে নেই যাত্রীছাউনি।
ভারতবর্ষে প্রথম রেল চালুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এ রেলস্টেশন ভবনের গোড়াপত্তন বলে ধারণা করা হয়। বিলের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রেললাইন অনেক উঁচুতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সে কারণেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই এখানে দোতলা স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হয়। মোগল আর ইংরেজ আমলের বিশেষ স্থাপত্যশৈলীর এক অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এ দ্বিতল স্টেশনটি।
এখানে শুধু দোতলা স্টেশন ভবনই নির্মাণই করা হয়নি; দোতলা রেলস্টেশনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ইউরোপ থেকে সৌন্দর্যবর্ধক বহু বিরল প্রজাতির গাছ নিয়ে এসে রোপণ করা হয়েছিল। সেগুলোর অবশিষ্ট অংশ হিসেবে এখনো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বিরল প্রজাতির একটি পামট্রি রয়েছে।
আলমডাঙ্গা স্টেশনে দীর্ঘদিন ধরে কুলির কাজ করছেন হায়দার আলী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বয়সতো অনেক হলো। অনেক আগে থেকে এখানে কুলির কাজ করি। এই স্টেশনটা মূলত ইংরেজরা করেছিল। এরাম (এরকম) দোতলা স্টেশন আর কোথাও নেই। অনেক মানুষ দেখতে আসে এটা। তবে স্টেশনের মেরামত খুব দরকার। সেই ইংরেজরা কবে করে গেছে। এখনো সেভাবেই আছে।’
আরও পড়ুন: পয়োবর্জ্য শোধনাগারে রূপ ফিরছে চমৎকার চুয়াডাঙ্গার
তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে। সেসময় চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপিত হয়। নীলকরদের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের কারণে বিতাড়িত কিছু নীলকর জগতিতে আখ মাড়াইয়ের কল উৎপাদন শুরু করেছিলেন। ভারী ভারী আখ মাড়াইয়ের কল বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের কাছে পৌঁছানো সহজ হবে রেলপথে। এমন চিন্তা থেকেই কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেললাইন স্থাপিত হয়। পরে ১৮৬২ সালে আলমডাঙ্গায় দ্বিতল রেলস্টেশনটি নির্মাণ করা হয়।
পরে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি গোয়ালন্দ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ১৮৯৭ সালে দর্শনা-পোড়াদহ সেকশনটি (অঞ্চল) সিঙ্গেল লাইন থেকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯০৯ সালে পোড়াদহ-ভেড়ামারা, ১৯১৫ সালে ভেড়ামারা-ঈশ্বরদী এবং ১৯৩২ সালে ঈশ্বরদী-আব্দুলপুর সেকশনগুলোকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়।
আলমডাঙ্গায় কুমার নদের ওপর ‘লাল ব্রিজ’ খ্যাত বর্তমান রেলওয়ে ব্রিজটি ১৯০৯ সালে উদ্বোধন করা হয়। পরে কালিদাসপুর থেকে রেলস্টেশন আলমডাঙ্গায় স্থানান্তরিত হয় বলে জানা যায়।
স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আনছার আলী নামের এক বৃদ্ধ। তিনি বলেন, ‘স্টেশনের দ্বিতল ভবন মূলত ১৭৫৩ সালের পরে তৈরি। কারণ তখন ব্রিটিশরা ভবনটি অত্র এলাকার নীল চাষের অফিস হিসেবে ব্যবহার করতো। এ স্টেশনের নিচের ভবনে যে কত নীল চাষির রক্ত মিশে আছে, সেটা বলাই বাহুল্য।’
আরও পড়ুন: এক পেঁয়াজু ৪ কেজি, লেগেই থাকে ক্রেতার ভিড়
সরেজমিন দেখা গেছে, রেলস্টেশনের মূল ভবনটি সংস্কার করা হয়নি। সামনের দেওয়ালের ইট-সুরকির ফাঁকে জন্মিয়েছে কলাগাছ। আশপাশে জঙ্গলের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
এ অবস্থায় রেললাইন ও স্টেশন সংস্কার, ঢাকাগামী ট্রেনের বরাদ্দ সিট সংখ্যা বৃদ্ধি ও নতুন ট্রেনসহ বেশকিছু দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে দেশের একমাত্র দ্বিতল রেলওয়ে স্টেশন ভবনের আদি নির্মাণশৈলী অক্ষুণ্ন রেখে আধুনিকায়ন, আপ ও ডাউন প্ল্যাটফর্ম বর্ধিতকরণ, এক্সপ্রেস রোড ও ফুটওভার ব্রিজ স্থাপন, যাত্রী ছাউনি বর্ধিতকরণ ও চিত্রা-সুন্দরবন এক্সপ্রেসের বরাদ্দকৃত আসন সংখ্যা বৃদ্ধি।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে যাওয়ার জন্য বাচ্চা নিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মাহবুবুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আলমডাঙ্গা স্টেশনটা অনেক পুরোনো। এ স্টেশনে বসার পরিবেশ ভালো না। বিল্ডিংগুলোরও দুর্দশা অবস্থা। দেশের একমাত্র দোতলা স্টেশন নানা সমস্যায় জর্জরিত। অথচ কর্তৃপক্ষের কোনো খেয়ালই নেই।
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা গীতা পাল নামের এক নারী যাত্রী বলেন, ‘দোতলা স্টেশনে নামতে খুব কষ্ট হয়। কারণ সিঁড়ি ঘরটা ভালো না। যে কারণে ঘুরে যেয়ে নামতে হয়। ওইদিকটা সংস্কার করা দরকার।’
আরও পড়ুন: ‘কাঁচা ঝালের দাম এতো কুনুদিন দেকিনি’
যাত্রী তরুণ কুমার সাহা বলেন, ‘স্টেশনের মূল সিঁড়ি ভবন অনেকটা অকেজো হয়ে রয়েছে। সিড়িতে পর্যাপ্ত আলো না থাকায় রাতে নামতে ভয় করে। মাদকসেবীদের কারণে রাতে যাত্রীরা ভয়ে থাকেন। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।’
আনন্দধাম এলাকার এক যাত্রী বলেন, ‘এটা একটি প্রাচীন রেলস্টেশন। এখানে প্রায় সব ট্রেনই থামে। মেইন প্ল্যাটফর্মে টয়লেট আছে কিন্তু দ্বিতীয় প্লাটফর্মে যাত্রীছাউনি নেই, টয়লেটও নেই। এ কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের।’
এ বিষয়ে আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আলমডাঙ্গা স্টেশনের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে এটা ভাঙার সুযোগ নেই। স্টেশনের অনেক সংস্কার হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে বর্তমানে ওপারের অর্থাৎ ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাত্রী স্থাপনসহ টুকিটাকি বেশ সংস্কার প্রয়োজন। আমরা ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে সমস্যাগুলো আগেই জানিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, এখানে কর্মরত আছি প্রায় ৭-৮ বছর। অনেক মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে শুধু স্টেশনটি দেখতে আসেন। আমারও বেশ ভালো লাগে। এখানে এখনো একটা পামট্রি ও একটি কাঠমল্লিক গাছ আছে, যেটা ব্রিটিশরা লাগিয়ে ছিল।
এসআর/জেআইএম