ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ সংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারের সামনের রাস্তায় ফেরি করে নিয়মিত বই বিক্রি করেন রেজাউল করিম মদু ওরফে মদু মণ্ডল নামের এক যুবক। চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুরহুদা থানার সদাবরি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষকের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড় সন্তান তিনি। ঢাকায় থাকাখাওয়া ও লেখাপড়ার খরচ মেটানোর পাশাপাশি গ্রামে বাবা মায়ের কাছে কিছু টাকা পাঠাতে তিন বছর যাবত ভ্যানগাড়িতে ফেরি করে বই বিক্রি করছেন মদু মণ্ডল। সাত সকালে ঘুম ভেঙে চারুকলার সামনে চলে আসেন। থরে থরে বই সাজিয়ে রেখে ক্রেতাদের অপেক্ষায় থাকেন। এক সময় ফুটপাতে উচু স্বরে ডাকাডাকি করে বই বিক্রি করলেও এখন তার ভ্যনগাড়িতে কাঠ দিয়ে বেধে রাখা ‘বইপোকা একজন বইওয়ালা’ সাইনবোর্ডের লিখাটি দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলার শিক্ষার্থী ও পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়ে বই হাতড়ে দেখেন। পছন্দ হলে কিনে নেন। মদুর স্বপ্ন ইঞ্জিনচালিত মোটরভ্যানে করে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে ঘুরে ঘুরে বই কিনতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা। কিন্তু টাকার অভাবে এখনও তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি।আজ (বুধবার) সকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে দরিদ্র পরিবারের সন্তান রেজাউল করিম মদু তার সংগ্রামী জীবনের গল্পগাঁথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় একটি কলেজ থেকে বিএ পাশ করে ২০০৭ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান। বাড়ি থেকে যে হাজার ছয়েক টাকা নিয়ে এসেছিলেন সেটা ধানমন্ডি ল’ কলেজে ভর্তি হওয়া ও কিছুদিন খাওয়াদাওয়ায় শেষ হয়ে যায়। পরে জীবিকার তাগিদে ঢাকার পথে পথে ঘোরাঘুরি করতে থাকেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন চারুকলার সামনে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্টের ছাত্র জনৈক রিপন ভাইকে ফুটপাতে বই বিক্রি করতে দেখে তার কাছে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে সহায়তা চান। তিনি সদয় হয়ে তার সঙ্গে ফুটপাতে বই বিক্রির কাজে লাগিয়ে দেন। তখন ফুটপাতে পাঁচ ও দশ টাকা দামের বই বিক্রি করতেন। ডানে দশ বায়ে পাঁচ, বাইছ্যা লন, দেইখখা লন সুর করে ডেকে বই বিক্রি করতেন। দিন শেষে রিপন তাকে হাত খরচ দিতেন। এক সময় সে বই বিক্রিতে রিপনকে ছাড়িয়ে যান।মদু বলেন, থাকার জায়গা ছিল না, রাতে আর্ট কলেজের ভেতরে মাথা গুজে পড়ে থাকতেন। তখন ল’ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শেষ। সংগ্রামী জীবন আর ভাল লাগছিল না। অনেকটা আশাহত হয়ে গ্রামে ফিরে যান। কিছুদিন কৃষিজমিতে কামলা খাটেন। কিছুদিন পর একটি এনজিও থেকে কয়েক হাজার টাকা ঋণ নিয়ে স্থানীয় কারপাশডাঙ্গা এলাকায় জ্ঞানাগার নামে একটি লাইব্রেরি দেন। বিএ পাশ করে চাকরি না করে লাইব্রেরি দেয়ায় পরিবারের সবাই রাগারাগি করেন এবং ঢাকায় গিয়ে চাকরি বাকরির চেষ্টা করতে বললেন। ২০১৩ সালে আবার ঢাকায় ফিরে এসে রিপন ভাইকে একটি ভ্যানগাড়ি কিনে দিতে অনুরোধ জানালে তিনি ৯ হাজার টাকা দিয়ে একটি ভ্যানগাড়ি কিনে দেন। প্রকাশকদের কাছ থেকে বাকিতে বই তুলে দেন। সারাদিন বই বিক্রি করে দৈনিক ১০০টাকা করে ভ্যানগাড়ির টাকা পরিশোধ করতে থাকেন। গত তিন বছরে বেশ কিছু প্রকাশকের সঙ্গে তার ভাল পরিচয় হয়েছে। তারা বাকিতে বই সরবরাহ করে থাকেন। পাশাপাশি মদু নিজেও নীলক্ষেত ঘুরে ভাল ভাল বই সংগ্রহ করে এনে বিক্রি করেন।মদু মণ্ডল জানান, তিন বছর যাবত একই জায়গায় বই বিক্রি করছেন। প্রতিদিন দুই আড়াইহাজার টাকার বই বিক্রি করেন। প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে ৫শ থেকে ৭শ টাকা পাঠাতে পারেন। তিনি জানান, তার একটি স্বপ্ন মোটর ইঞ্জিনচালিত একটি ভ্যান গাড়ি কিনে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করা। রেজাউল করিম মদু ওরফে মদু জানান, কারও কাছে সাহায্য নয়, ঋণ হিসেবে টাকা পেলে তিনি স্বপ্ন পূরণ করতে পারতেন। স্বপ্ন যখন দেখেছি, স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে এ দৃঢ় বিশ্বাস তার আছে। সারাদিন বই বিক্রি শেষে তার ভ্যানগাড়িটি শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রাখেন। অবশ্য এ জন্য মাসিক কিছু টাকা পরিশোধ করতে হয় বলে জানান। এমইউ/একে/আরআইপি