নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও দূর্গাপুর সীমান্ত পার হয়ে অবৈধভাবে আসছে ভারতীয় চিনি। প্রায়ই জেলা পুলিশের অভিযানে জেলার বিভিন্ন সড়কে জব্দ করা হয় ভারতীয় চিনি। চোরাকারবারিরা এ দুই উপজেলার কয়েকটি সীমান্ত পথ দিয়ে চিনি এনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সীমান্ত চোরাচালান দ্বন্দ্বে গত এক বছরে একজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও সাংবাদিকসহ পাঁচটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর চোরাকারবারিদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জেলার দুর্গাপুরে শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালেও ২ হাজার ৪৭৫ কেজি (৫৫ বস্তা) ভারতীয় চিনিসহ একজন চোরাচালানিকে আটক করেছে পুলিশ। এ সময় চোরাচালান কাজে ব্যবহারের একটি কার্গো ট্রাক জব্দ করা হয়। উপজেলার ঝানজাইল এলাকা থেকে এসব চিনি আটক করা হয়। আটক চোরাচালানি মো. ওবায়দুল্লা হক নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার কাদিগাটা গ্রামের বাসিন্দা।
পুলিশ জানায়, ভারত থেকে চোরাই পথে ওই চিনি দেশীয় কোম্পানির চিনির বস্তায় ভর্তি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হয়। অবৈধভাবে চোরাই পথে আনা চিনি পাচার হচ্ছে এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে একটি কার্গো ট্রাকের ভেতর থেকে ৫৫ বস্তা চিনি জব্দ করা হয়। যার বর্তমান বাজারমূল্য ২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
জেলা পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত তিন মাসে জেলার সীমান্ত পথে অবৈধভাবে আসা ভারতীয় চিনির অন্তত পাঁচটি চালান জব্দ করা হয়। এতে একটি পিকাপসহ ৫৮৮টি বস্তায় ২৭ হাজার ৫৩৫ কেজি ভারতীয় চিনি পায় পুলিশ। যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৪৮ লাখ ৬ হাজার ৫০ টাকা। গত বছরের ২২ আগস্ট থেকে এ বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চোরাইপথে আসা এসব সামগ্রীর দাম এক কোটি ২২ লাখ ২৯ হাজার ৭৬ টাকা। এসব ঘটনায় ২৫৬টি মামলা ও ৪১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। একই সময়ে বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরাও বিপুল পরিমাণ ভারতীয় চোরাইপণ্য আটক করেছে।
এ দুই উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চোরাকারবারিরা প্রতিদিন চিনি এনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করছে। ৫০ কেজি ওজনের প্রতিটি বস্তা ভারত সীমান্ত থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকা দরে কিনে শ্রমিকের খরচসহ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছাতে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়। এসব বস্তা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পাঁচ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। চিনির বস্তা সীমান্ত থেকে স্থানীয় বাজারে আনতে ‘লাইনম্যান’সহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে স্তরে স্তরে দিতে হয় টাকা।
কলমাকান্দার লেংগুরা ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি ও সাত শহীদের মাজার সীমান্ত এলাকার দুজন চোরাকারবারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, চিনি আনতে চোরাকারবারিরা দুর্গাপুরের ভরতপুরের গাজীকোনা, বারোমারির লক্ষ্মীপুর, বিজয়পুর, চণ্ডীগড়ের ফেচিয়া, কলমাকান্দার লেংগুরা ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি, জগন্নাথপুর, চেংগ্নী, সাত শহীদের মাজার, কালাপানি, তকলেটবাড়ি, খারনৈ ইউনিয়নের বৌ-বাজার, বলমাঠ, কচুগড়া, রংছাতি ইউনিয়নের পাতলাবন, পাঁচগাঁও, সন্ন্যাসীপাড়া, বেতগড়া, জাকিরপাড়া, নক্লাই, রামনাথপুরসহ বিভিন্ন সীমান্ত পথ ব্যবহার করে। প্রথমে সীমান্ত থেকে সাইকেল, মোটরসাইকেল, রিকশা ও ইজিবাইকে করে দুর্গাপুর বাজার, কলমাকান্দা বাজার ও নাজিরপুর বাজারে কিছু ব্যবসায়ীর গুদামে এসব চিনি মজুত রাখা হয়। পরে পিকআপভ্যান ও ছোট ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
গুদামে রেখে ভারতীয় বস্তা পাল্টে দেশীয় কয়েকটি কোম্পানির নামে সিল মারা বস্তায় ভরা হয় চিনি। পরে মধ্যরাতে পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকে করে হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। চোরাই চিনিভর্তি যানবাহন নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য রাতের আঁধারে সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে থাকেন লাইনম্যান হিসেবে পরিচিত চোরাচালানি দলের সদস্যরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চিনির সঙ্গে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রসাধনী, চকলেট, বিস্কিট, মসলা, পোশাক, গাড়ির যন্ত্রাংশ, মদ, ফেনসিডিলসহ মাদকও আসছে।
জেলা পুলিশের তথ্যমতে, গত তিন মাসে জেলা পুলিশের ১২টি অভিযানে ১৮ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ গত ১৯ সেপ্টেম্বর দুর্গাপুর সীমান্তে চার হাজার ৪৫৫ কেজি (৯৯ বস্তা) চিনির একটি বড় চোরাচালান উদ্ধার করে পুলিশ। ওই চিনির মূল্য চার লাখ ৯০ হাজার ৫০ টাকা।
এদিকে কলমাকান্দার লেংগুরা বাজার এলাকায় শাহ আলম নামের এক ব্যক্তি পুলিশের কথা বলে চোরাকারবারিদের কাছ থেকে প্রতি বস্তায় ১০০ টাকা করে নেন। আর একই উপজেলার নাজিরপুর মোড় এলাকায় মো. সুজন মিয়া নামের এক যুবক নেন ৫০ টাকা করে।
টাকা নেওয়ার কারণ হিসেবে তারা দুজনই বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে কিছু চিনি আসছে। এজন্য সবকিছু ম্যানেজ করতে এই টাকা নেওয়া হয়।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরের সীমান্ত দিয়ে চিনি, মাদক ছাড়াও ভারতীয় গরু, শাড়ি, প্রসাধনসামগ্রীসহ অবৈধভাবে নানা পণ্য ঢোকে। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয় সুপারি। চোরাকারবারিরা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নাম ভাঙিয়ে হুমকি দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চোরাচালান ঘিরে খুন
চিনির ট্রাক আটকাতে গিয়ে গত ২০ সেপ্টেম্বর ভোরে নেত্রকোনা পৌরসভার রাজুরবাজার এলাকায় জাবির মিয়া নামের চোরাচালানি দলের এক সদস্যের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় সাহারা আক্তার (৩৫) নামে এক নারী সাংবাদিক নিহত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই সাংবাদিক ‘আলোর জগৎ’ নামে ঢাকার একটি পত্রিকার ফটোসাংবাদিক ছিলেন।
সাহারার সঙ্গী ওই দুর্ঘটনায় আহত ফেরদৌসী আক্তার বলেন, ‘আমাদের মোটরসাইকেলটিকে ট্রাকের পেছনে আসা অন্য একটি মোটরসাইকেল ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এতে আমার সহকর্মী সাহারা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ সময় চোরাচালানি দলের কমপক্ষে ১০ জন সদস্য আমাকে মাটিতে ফেলে মারধর করে।’
এছাড়া গত ৩১ মার্চ রাতে দুর্গাপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুর সীমান্তে বাংলাদেশ থেকে সুপারি পাচারের সময় চোরাকারবারিরা দেশি অস্ত্র নিয়ে টহলরত বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা করে। এ সময় আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়লে বিজিবির গুলিতে আমিনুল ইসলাম নামের এক চোরাকারবারি নিহত হন।
এদিকে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে দুর্গাপুর উপজেলার রাশিমনি বাজারে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সুব্রত সাংমার ওপর সীমান্ত ব্যবসার বিরোধে হামলা চালায় বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল ও তার ভাই শামীম আহমেদের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত। পরে তিনি ওই বছরের ২২ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
চোরাচালান দ্বন্দ্বে সর্বশেষ গত ২৪ সেপ্টেম্বর (শনিবার) জেলার দুর্গাপুরে নুর নবী (৪৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীর ওপর হামলা চালিয়ে মারাত্মক আহত করা হয়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত নুরনবী ওই উপজেলার বিরিশিরি ইউনিয়নের নলজোড়া গ্রামের বাসিন্দা। নুর নবীর পরিবারের সদস্যদের দাবি, এলাকার চোরাকারবারি শামীম আহমেদ ওরফে শুটার শামীমের নেতৃত্বে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এ হামলা করা হয়।
এছাড়া চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের তারানগর গ্রামের ফালু মিয়ার ছেলে হেলাল মিয়া (২৮) খুন হন এবং দুর্গাপুরের বিজয়পুর টিলাপাড়া আলম মিয়া (৩৫) একই মাসে খুন হন। এসব খুনের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে চোরাচালান জড়িত বলে জানান স্থানীয়রা।
নেত্রকোনার পুলিশ সুপার মো. ফয়েজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে চোরাচালান রোধে নিয়মিত অভিযান চলছে। সীমান্তে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযান বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের কয়েকটি ইউনিটের সমন্বয়ে টিম করে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
এফএ/জেআইএম