বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় দিনদিন বাড়ছে অনুমোদনহীন ট্রলিং বোটের দৌরাত্ম্য। এসব নৌযানে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে নির্বিচারে শিকার করা হচ্ছে পোনা মাছ। ফলে বিপন্ন হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ। এতে ভেস্তে যাচ্ছে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারের সব পরিকল্পনা।
গবেষকরা বলছেন, নিষিদ্ধ জালে মাছ ধরায় সব ধরনের মাছের পোনা, রেণু ও জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বড় মাছের খাদ্য শৃঙ্খলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়ানো ট্রলিং বোটগুলোর মধ্যে বরগুনায় রয়েছে অর্ধশতাধিক। নীতিমালা অনুযায়ী ৪০ মিটার গভীরতার কম পানিতে মাছ শিকার করতে পারবে না ট্রলিং বোট। তবে নীতিমালার তোয়াক্কা না করে সাগরের তীরবর্তী এলাকায় মাছ ধরছে এসব ট্রলিং বোট। এসব নৌযানে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করায় পোনাসহ মারা পড়ছে সব প্রজাতির মাছ।
আরও পড়ুন:
গবেষকদের মতে, বর্তমানে সমুদ্রে ক্যাটফিশ প্রজাপতির মেদ, মোচন, গাগড়া এবং ট্যাংরা মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। পিনিয়াস প্রজাতির কোরাল এবং জাভা মাছের উৎপাদনও কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে নির্বিচারে মাছ আহরণ করায় সমুদ্রে মাছ উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। এতে লোকসানের মুখে পড়বেন এ অঞ্চলের জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে এ অবতরণকেন্দ্রে মোট মাছ বিক্রি হয়েছে ৩৫৮৭.১৭ মেট্রিক টন। আর ২০২৪ সালে বিক্রি হয়েছে ৩৪০৫.৮১ মেট্রিক টন। ২০২৩ সালের তুলনায় গতবছর এ অবতরণকেন্দ্রে মাছ অবতরণ হয়েছে কমেছে প্রায় ২০০ মেট্রিক টন। মাছের অবতরণ কম হওয়ায় অবতরণকেন্দ্রে বছরজুড়ে মাছ বিক্রি হয়েছে আকাশচুম্বি দামে। এ কারণে রাজস্ব আদায় বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে বিক্রি হওয়া মাছের মোট দামের শতকরা ১.২৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় করে সরকার।
সরেজমিন পাথরঘাটা ঘুরে দেখা যায়, সমুদ্রে মাছ শিকার শেষে বিভিন্ন স্থানে নোঙর করে আছে অনুমোদনহীন ট্রলিং বোট। কিছু ট্রলিং প্রস্তুতি নিচ্ছে সাগরে যাওয়ার। শ্রমিকরা ব্যস্ত মাছ ট্রাকে উঠাতে। স্থানীয় আড়তদারের মাধ্যমে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঢাকাসহ সারাদেশে চালান করে বিক্রি করছেন এ মাছ। আবার কিছু মাছ চাতালমালিকরা শুঁটকি করেও বাস-ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে বিক্রি করছেন।
আরও পড়ুন:
মাছ না পাওয়ার হতাশা নিয়ে মিরাজ নামের একজন জেলে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্রলিং বোটের জালে বড় থেকে গুঁড়া সব রকমের মাছ সাগর থেকে ধরে ফেলে। আমরা সাগরে বা নদীতে মাছ পাই না। আমাদের ট্রলারে বাজার খরচই ওঠে না। এটা বন্ধ না হলে আমরা বাঁচতে পারবো না।’
পাথরঘাটা এলাকার ইলিশ শিকারি জেলে সরোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্রলিংয়ে যে জাল ব্যবহার হয় সেটা এমন যে, ইলিশ মাছের পোনাও এই জালের ফাঁসে আটকা পড়ে। তাই সাগরে এখন ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। ইলিশ শিকারের জন্য ট্রলারে আমরা ১৪ জন সাগরে ১০ দিনের জন্য যাই। এখন মাছ না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। আমরা ট্রলিং বোট বন্ধের দাবি জানাই।’
জামাল নামের আরেকজন জেলে বলেন, ‘ট্রলিং বোট হওয়ার পর থেকে আমার সাধারণ জেলেরা না খেয়ে মরে যাচ্ছি। এরা ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে সব মাছ ধরে ফেলে আর আমরা মাছ পাই না। এদের দেখাদেখি এখন অনেক ট্রলার মালিকই এই জাল বানাচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে মাছের আকাল দেখা দেবে। আমরা চাই এসব অবৈধ জাল বন্ধ হোক।’
আরও পড়ুন:
দাম বেশি, ক্রেতা নেই ইলিশেরপাথরঘাটা বিএফডিসি বিপণন কর্মকর্তা ও মৎস্য গবেষক বিপ্লব কুমার সরকার জাগো নিউজকে জানান, ট্রলিং দুই প্রকার। একটি যান্ত্রিক ট্রলিং, আরেকটি হ্যান্ড ট্রলিং। যান্ত্রিক ট্রলিং গভীর সমুদ্রে বড় মাছ ধরে। হ্যান্ড ট্রলিং আকারে ছোট হওয়ায় এরা উপকূল এলাকায় মাছ ধরে সব রকমের মাছের রেণু ধ্বংস করছেন। এরা মূলত নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছের ফিডিং গ্রাউন্ড ও প্রজনন ক্ষেত্রে জাল ফেলে সব রকমের জলজ উদ্ভিদ জাল দিয়ে উঠিয়ে ফেলছেন। এতে জেলেরা সাময়িক লাভবান হলেও পরবর্তী সময়ে এখানে আর মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী ট্রলিং বোট যে জাল ব্যবহার করছে সেটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই জালে সামুদ্রিক সব রকমের পোনা মাছ আটকে যায়। তাই মাছের স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া নষ্ট হচ্ছে। এই জাল নিষিদ্ধ না করা হলে ভবিষ্যতে মাছের আকাল দেখা দেবে। সমুদ্রে অনেক প্রকার মাছ হারিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:
পাতে ফিরেছে বিলুপ্তপ্রায় ৪০ প্রজাতির দেশি মাছএ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন জাগো নিউজকে বলেন, নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে মাছ আহরণ ও অসাধু জেলেদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে ট্রলিং বোটের মালিকরা আদালতে রিট করায় কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারছি না।
মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ মোতালেব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ট্রলিং নিষিদ্ধ না করার রিট করা হয়েছে। রিটের সময় কাল শেষ হলে সরকার যদি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে, তাহলে আবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে।
নুরুল আহাদ অনিক/এসআর/এমএস