মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান (রহ.)
Advertisement
উর্দু থেকে অনুবাদ: মওলবি আশরাফ
হাদিসে এসেছে—জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) মদিনায় ৯ বছর অবস্থান করেন কিন্তু হজ করেননি। তারপর দশম হিজরিতে হজের ঘোষণা দেওয়া হলো—রাসুল (সা.) এবার হজে যাচ্ছেন। ফলে মানুষের ঢল নেমে এলো। আমরাও তার সঙ্গে রওয়ানা হলাম। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ১৪৭০৫)
প্রশ্ন ওঠে—হজের সুযোগ থাকার পরও তিনি আট ও নয় হিজরিতে কেন হজ করলেন না? হিজরতের পর প্রথম দিকে কোরাইশের বাধার ভয় ছিল—যেমন ষষ্ঠ হিজরিতে হোদায়বিয়ার সন্ধি যখন হয়, তখন তাকে ওমরাহ করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর তো এই বাঁধা আর ছিল না! তবুও রাসুল (সা.) হজ করেন দশম হিজরিতে—তার দু’মাস পর তিনি ইন্তেকাল করেন।
Advertisement
এই দেরি করার কারণ ছিল এই যে, নবিজি (সা.) হজ পালন করার আগে হিজরি ক্যালেন্ডার ও হজের সময়সূচিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে চাচ্ছিলেন যেন তিনি আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত সঠিক সময়ে হজ পালন করতে পারেন।
মাস গণনা হয় দুইভাবে—চাঁদ দেখে ও সূর্যের গতিপথ হিসাব করে। প্রতি মাসে চাঁদ একবার বাড়ে ও কমে, এতে মাসের হিসাব রাখা খুবই সহজ। কিন্তু সৌরবর্ষের বিহাস অনেক হিসাব-নিকাশ আর গণনার ওপর নির্ভরশীল। সোজা কথায়—চান্দ্র মাসের হিসাব চোখে দেখেই রাখা সম্ভব, কিন্তু সৌরমাসের হিসাব জটিল গাণিতিক হিসাব নিকাশ ছাড়া সম্ভব নয়।
আল্লাহ তাআলা হজ, রোজা ইত্যাদি ইবাদত পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন চাঁদের হিসাব অনুযায়ী। এর মানে এই নয়—চান্দ্রপঞ্জিকা পবিত্র আর সৌরপঞ্জিকা মন্দ! যে আল্লাহ চাঁদের গতি নির্ধারণ করেছেন, তিনি সূর্যেরও মালিক। কাজেই একটিকে পবিত্র আর অন্যটিকে অপবিত্র বলার সুযোগ নেই। মূলত এর পেছনে আকিদাগত কোনো বিষয় নেই, বরং এটি ব্যবহারিক ব্যাপার। ইবাদতের কাঠামো গড়া হয়েছে স্বাভাবিক সরলতার মানদণ্ডে। আর সে কারণে চান্দ্রপঞ্জিকাকেই ইবাদতের সময় নির্ধারণের জন্য ভিত্তি বানানো হয়েছে।
হযরত ইবরাহিম (আ.) চাঁদের প্রকৃত হিসাবেই হজের প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু কোরাইশ গোত্র, যারা পবিত্র কাবার দায়িত্বে ছিল, তারা নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে চাইলো যে হজের সময়টা সৌর পঞ্জিকার ওপর নির্ধারিত হোক, যেন প্রতিবছর হজ একই মৌসুমে পড়ে।
Advertisement
সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনের, আর চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ দিনের। অর্থাৎ দুইয়ের মাঝে ১১ দিনের পার্থক্য। এই হিসেবে প্রতি আট বছরে প্রায় তিন মাসের ব্যবধান তৈরি হয়। আরবরা এই পার্থক্য নিরসনের জন্য চান্দ্র মাসে অতিরিক্ত দিন যোগ করত, যেন চান্দ্র ও সৌর মাস পাশাপাশি চলতে পারে। ফলে চান্দ্র মাস তার নিজস্ব অবস্থান থেকে সরতে থাকত। চাঁদের ঘূর্ণন ৩৩ বছর পর একই অবস্থানে ফিরে আসে। ফলে টানা ৩৩ বছর হজ নিজস্ব নির্ধারিত তারিখে না হয়ে অন্য তারিখে অনুষ্ঠিত হতো আর ৩৪তম বছরে তা আবার মূল ইবরাহিমি তারিখ—অর্থাৎ জিলহজ মাসে—ফিরে আসতো।
৮ম হিজরির রমজান মাসে যখন মক্কা বিজয় হয়, তখন এই ৩৩ বছরের চক্র শেষ পর্যায়ে ছিল। অর্থাৎ ৮ হিজরি ও ৯ হিজরির হজ পূর্বের রীতি অনুযায়ী জিলকদ মাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু ১০ হিজরিতে সেই ৩৩ বছরের চক্র পূর্ণ হলো, এবং হজ ঠিক তার মূল তারিখ অর্থাৎ জিলহজে এসে পড়ল।
রাসুল (সা.) এক অর্থে ইবরাহিমি দীনের ‘মুজাদ্দিদ’ ছিলেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যেন হজের ব্যবস্থাকে আবার ইবরাহিমি ভিত্তিতে সঠিক হিসাবে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি চাইলে ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর সঙ্গে সঙ্গে এ ঘোষণা দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এমনকি ৯ম হিজরিতেও করলেন না। এই প্রয়োজনীয় কাজটি করলেন ১০ম হিজরিতে গিয়ে, যখন হজের তারিখ আপনা-আপনি আবার ইবরাহিমি তারিখে ফিরে এলো।
এর কারণ ছিল, ৮ম ও ৯ম হিজরিতে তা করতে গেলে শত শত বছরের প্রথা ভাঙার কারণে মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি তৈরি হতো। কিন্তু ১০ম হিজরিতে এই লক্ষ্য পূরণ হয় কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করেই।
১০ম হিজরিতে নবিজি (সা.) নিয়মমাফিক সঠিক তারিখে হজ পালন করলেন, তারপর ঘোষণা করলেন—এখন থেকে চাঁদের বছরের হিসাব তার স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। জাহেলি যুগের মতো চাঁদের বছরের হিসাবে অতিরিক্ত দিন যোগ করা হবে না।
বিদায় হজের খুতবায় রাসুল (সা.) বললেন, হে লোকসকল, কালের চক্র ঘুরে গিয়ে আজ ঠিক সেই অবস্থানে এসেছে, যে দিন আল্লাহ আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছিলেন এবং আল্লাহর কাছে বছর বারো মাসেই হয়। (সহিহ বুখারি: ৫৫৫০, সহিহ মুসলিম: ১৬৭৯)
অর্থাৎ ৩৩ বছরের কৃত্রিম চক্র পূর্ণ হয়ে আজ ৯ জিলহজ আবার ৯ জিলহজেই পড়েছে। এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক বিধান। পূর্বের বানানো বর্ষপঞ্জি বাতিল করা হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে হজ প্রতিবারই এই স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জিলহজ মাসেই আদায় করা হবে।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও লেখক
ওএফএফ/জেআইএম