সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর আসল লক্ষ্য ছিল বিচারপতিদের স্বাধীনতাকে সংকটে ফেলা। এমন মন্তব্য করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আদালত বলেন, রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আবার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা অক্ষমতা বা আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারে।
Advertisement
চূড়ান্ত রায়ে বলা হয়- ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়বস্তু কী ছিল? আদালত মন্তব্য করেন, এটি ছিল কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী শাসকের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট প্রয়াস, যেখানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে কেড়ে নিয়ে সংসদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকেই হুমকির মুখে ফেলা হয়েছিল।
গত বছরের ২০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ ও নিয়মিত বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। মোট ৫০ পৃষ্ঠার এই পূর্ণাঙ্গ রায় বৃহস্পতিবার (৫ জুন) প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষণসহ মামলাটি নিষ্পত্তি করা হলো।
রায়ে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী মন্তব্য করেন, যদি কোনো বিচারক তার বিচারিক দায়িত্ব পালনের সময় সরকারের রোষানল কিংবা অসন্তোষের মুখোমুখি হন, তাহলে সংসদ সদস্যদের কলমের এক খোঁচায় তাকে অপসারণ করা সম্ভব। এটা কি কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মেনে নেওয়া যায়? আমার গভীর বিবেচনায় এবং সহকর্মীদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে এর উত্তর, অত্যন্ত স্পষ্টভাবে, না।
Advertisement
রায়ে আরও বলা হয়, বিচারপতিদের উচিত বিচারিক কাজে রাজনৈতিক বিতর্কে না জড়ানো। কারণ, এমন মন্তব্য বিচারকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং তিনি তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়তে পারেন।
আদালত আরও বলেছেন, বিচারকদের উচিত রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ না করা। কারণ, এতে বিচারব্যবস্থার সুনাম ও স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
রায়টিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বর্ণনা করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কমর্কর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করার নতুন ভিত্তি পেয়েছে। এই রায় ইতিহাসে স্থান করে নেবে।
তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ঐতিহাসিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, তারা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন। আগে ৯৪টি কারণে রিভিউ চাওয়া হয়েছিল। আমরা সবগুলো ভালো করে দেখেছি এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছি, রিভিউ করার মতো কোনো কারণ পাওয়া যায়নি। আদালতকে জানিয়েছি, আমরা আর এসব কারণ দেখাব না।
Advertisement
এই মামলায় রিটকারীর পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ওইদিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া, আরশাদুর রউফ ও অনীক আর হক। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
২০১৬ সালের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের হাইকোর্ট বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। পরে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই সাত সদস্যের আপিল বিভাগ ওই রায় বহাল রাখে। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদন দায়ের করে, যার নিষ্পত্তি হয় ২০২৪ সালের অক্টোবরে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ছিল একটি ‘উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত আইন’ (Colourable Legislation) বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে গত বছরের ২০ অক্টোবর এ রায় দেন।
রায়ে পৃথক পর্যবেক্ষণ সহকারে সর্বসম্মতিক্রমে দেওয়ানি রিভিউ আবেদনটি নিষ্পত্তি করা হয়। ফলস্বরূপ, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণরূপে পুনর্বহাল করা হয়।
এই রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে ছয়জন বিচারপতি আলাদা আলাদা পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি ছাড়া রায় প্রদানকারী অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি সৈয়দ মো. জিয়াউল করিম, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস. এম ইমদাদুল হক।
এফএইচ/এএমএ