কাঁচা চামড়ার সবচেয়ে বড় আড়ত রাজধানীর লালবাগের পোস্তা এলাকা। ঐতিহ্যবাহী পোস্তা ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের দিন দুপুর থেকেই জমজমাট হতে শুরু করে। এবারও ঈদের দিন থেকে আসতে শুরু করে কাঁচা চামড়া। তবে তুলনামূলক কম চামড়া এসেছে। আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাভারের ট্যানারিতে চলে গেছে বেশিরভাগ চামড়া। ফলে এবার সংরক্ষণের টার্গেট পূরণ হয়নি। একই সঙ্গে চামড়ার গুটি পক্স, ভালোভাবে মাংস না ছাড়ানোসহ নানা কারণে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
Advertisement
চামড়া সংগ্রহ শুরু হওয়ার পরপরই অর্থাৎ ঈদের দিন দুপুর থেকে বিকেল ৫টার পর চামড়া কেনাবেচা জমে ওঠে পোস্তা এলাকায়। ঈদের দিন গভীর রাত পর্যন্ত চামড়া সংগ্রহ করা হয়। ঈদের দিন থেকে টানা তিন দিন চামড়া এসেছে পোস্তায়। তবে ঈদের চতুর্থ দিন মঙ্গলবার (১০ জুন) চামড়া সরবরাহ ছিল না বললেই চলে। আড়তে আসা চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করার কাজে ব্যস্ত আড়তের মালিক-শ্রমিকরা।
চার হাজার চামড়া কেনার টার্গেট ছিল কিন্তু মাত্র পনেরশো কেনা হয়েছে। এবার এর চেয়ে বেশি চামড়া কেনা যাবে না বলে মনে করেন শাহাদাত অ্যান্ড কোং এর মালিক সাহাদাত হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পোস্তা থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, এটা সবাই জানে। তারপরও ঢাকা শহর থেকে যেসব চামড়া এসেছে সেগুলো আমরা কিনতে পেরেছি। আবার বাইরে থেকে ঢাকায় ১০ দিনের আগে চামড়া ঢোকার অনুমতি নেই। তাই এবার চামড়ার সরবরাহ কম। টার্গেট পূরণ হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা কোন নিয়ম হলো। এবার পোস্তা দেখলে মনে হবে যেন একটা সুন্দর গোছানো জায়গা। কারণ চামড়ার সরবরাহ আগের বছরের মতো ছিল না।
আরও পড়ুন:
Advertisement
তিনি বলেন, আমাদের আগে চায়নারা এলসি দিয়ে মাল নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতো। আমরা পরে কাঁচা চামড়া ডেলিভারি দিতাম। আর এখন আমরা মাল সাপ্লাই দেওয়ার দুই, তিন সপ্তাহ পর টাকা দেয়। তারা জানেন যে বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ আছে সেখানে তাদের ব্যবসার জন্য পশুর চামড়া পাওয়া যাবে। এখন তারা তেমন তৎপরতা দেখাচ্ছে না। এমন কিছু বিষয়ে সরকার আন্তরিক না হলে চামড়া শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব না।
পোস্তা থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আবার বাইরে থেকে ঢাকায় ১০ দিনের আগে চামড়া ঢোকার অনুমতি নেই। তাই এবার চামড়ার সরবরাহ কম-শাহাদাত অ্যান্ড কোং এর মালিক সাহাদাত হোসেন।
১০ হাজার চামড়া কেনার টার্গেট থাকলেও এবার কিনেছেন ৩ হাজার চামড়া। টার্গেট পূরণ না হওয়ার বিষয়ে আনাস লেদারস ও তোবা লেদারস কমপ্লেক্সের মালিক হাসান কালু জাগো নিউজকে বলেন, এখানে আমার ঘর নেই। অন্যের গোডাউন ভাড়া নিয়ে চামড়া কিনছি। এবার পোস্তায় কোরবানির পশুর চামড়ার সরবরাহ অনেক কম। তেমনি পশুর চামড়ায় গত বছরের চেয়ে বেশি গুটি পক্স রয়েছে। তাই নষ্ট এবং অন্যান্য বিষয় মাথায় রেখে চামড়া কিনতে হচ্ছে। এবার বেশিরভাগ চামড়া যাচ্ছে সাভার। আর মানুষ না জেনে না বুঝে অসুস্থ পশু ও পক্সসহ চামড়া কিনে এসে লস দিচ্ছে। দোষ চাপাচ্ছে চামড়ার আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের ওপর। আবার অনেকের চামড়া কেটে যায়, মাংসসহ এবং সময় মতো লবণ না দিয়ে আমাদের কাছে নিয়ে আসছে। পঁচে যাওয়াই লস দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ছয়, সাত থেকে আট ও নয়শ টাকা পর্যন্ত দামে চামড়া কিনেছি। আর কোন মাদরাসা হলে গড়ে সব চামড়ার দাম সমান দেই। নষ্ট চামড়া ফেরত দেই না, আলাদা করে কম দামে কিনি।
রাজধানীর পোস্তায় চামড়ার আড়তে আসা দারুল উলুম নুরিয়া বাড্ডা মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা মুফতি মাহমুদুল হাসান অভিযোগ তুলে জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ঈদের দিন ৬৯৫টি চামড়া বিক্রি করতে পোস্তায় যাই কিন্তু আমাদের পরিচিত একজন আড়ৎদার তার নিজস্ব প্যাডে দাম লিখে এক লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে দেন। পরে তিনি বলেন, আমাদের আড়ৎ আজকে বন্ধ। পরিচিত আরেকজনকে দিয়েছি। ওনি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে চামড়ার দাম সাতশ ২৫ টাকা করে দেন। তবে আমাদের পরিচিত অনেকে মাদরাসার চামড়া আটশো থেকে সাড়ে আটশো টাকা ধরে বিক্রি করেছে।
Advertisement
চামড়ার মধ্যে গুটি পক্স, ভালোভাবে মাংস না ছাড়ানোসহ নানা কারণে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নষ্ট হওয়ার শঙ্কা।
চামড়ার সরবরাহ কম থাকায় টার্গেট পূরণ হয়নি বলেন কামাল অ্যান্ড সন্সের মালিক হাজি মো. কামাল উদ্দিন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা গত বছর চামড়া কিনেছিলাম আট হাজার পিস। আর এবার কিনেছি দুই হাজার। কারণ গত বছর যে সব গোডাউনে মাল রেখেছিলাম এবার সেই গোডাউনগুলো নেই। ভাড়া নেওয়ার মতো গোডাউন নেই। আর এখন তো আড়ত নেই।কত দামে চামড়া কিনেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন দামে কিনেছি। ছোট,বড় ও মাঝারি ছয়শো টাকা থেকে শুরু করে সাত, আট ও নয়শো টাকা। এর চেয়ে আরও বেশি বড় হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি।
আরও পড়ুন:
পোস্তায় কাঁচা চামড়ার সরবরাহ কম, দামে হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরামাঠ পর্যায়ে দাম নেই চামড়ারসরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়নি ৮৯ শতাংশ চামড়ামৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়ায় লোকসানের অভিযোগ করছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পোস্তায় আড়তের সংখ্যা অনেক কমেছে। এখন হাতেগোনা কয়েকটি আড়ত আছে। সব চলে গেছে সাভার। তাই মানুষ না জেনে চামড়া নিয়ে এসে কম দাম, চামড়া কিনছে না অভিযোগ তুলছে। আবার অনেকের গোডাউনে আড়তের নামে সাইনবোর্ড আছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খোঁজ নিয়ে দেখবেন সেটি ওই মালিকের না তিনি সেটা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়া নিয়ে কয়েকজন মিলে বা কোন ব্যবসায়ী চামড়া কিনছেন সেটা আসলে আড়তের মূল মালিক না। তাই মানুষজন আড়ৎদার মনে করে চামড়া বিক্রি করতে এসে ধরা খাচ্ছে।
চায়নারা এলসি দিয়ে মাল নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতো। আমরা কাঁচা চামড়া ডেলিভারি দিতাম। আর এখন আমরা মাল সাপ্লাই দেওয়ার দুই, তিন সপ্তাহ পর টাকা দেয়-ব্যবসায়ী
পোস্তা এলাকায় কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি মঞ্জুরুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, সরকার নির্ধারিত দরে ট্যানারির মালিকরা আড়তদারদের কাছ থেকে চামড়া কিনবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ যদি সকালের কোরবানির চামড়া রাতে পোস্তায় নিয়ে আসে দায় কার। আর সরকার লবণ দেওয়া চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে, লবণ ছাড়া না। এটাও বুঝতে হবে। তবে মাদরাসায় লবণ সরবরাহ করায় সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে লবণযুক্ত চামড়া ফুট হিসেবে ফড়িয়াদের কাছ থেকে কেনা হবে। এখন যেসব চামড়া আসছে সেটা লবণ ছাড়া সে জন্য এ চামড়া কমে ব্যবসায়ীরা কিনছেন। তবে শহরের চামড়া সন্ধ্যা ৬টা এবং শহরের বাইরের চামড়া যদি রাত ১০টার মধ্যে পোস্তায় আনা যায় তাহলে পচন রোধ করা সম্ভব হয়। সেই সঙ্গে দামও ভালো পাবে। আর যারা পারবেন না তারা যে যেখানে রয়েছেন, সেখানেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। নইলে গরমের কারণে চামড়া নষ্ট হতে পারে।
কোরবানির ঈদ মৌসুমে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
আরও পড়ুন:
ক্রেতারা বলছেন চামড়ার ‘ভালো’ দাম দিচ্ছেন, অখুশি বিক্রেতারাদেশে এবার ৯১ লাখ ৩৬ হাজার পশু কোরবানি, অবিক্রীত ৩৩ লাখসংরক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় প্রতিবছর অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কোরবানির চামড়া নষ্ট হয়। বর্তমানে গরম অনেক বেশি, এ ছাড়া জ্যামের কারণে চামড়া নিয়ে আসতেও অনেক সময় লাগে। তাই পোস্তা এলাকায় সবাইকে চামড়া না এনে নিজ নিজ এলাকায় লবণজাত করার পরামর্শ দিচ্ছি। এ বছর চামড়া ব্যবস্থাপনা আশা করছি ভালো। সরকার এ ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
তিনি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য তুলে ধরে জানান, এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার। সেখানে গরু-ছাগলসহ কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার পশু। চলতি বছর কোরবানির ঈদ মৌসুমে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন ট্যানারি মালিকরা।
এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম