১৯ মে ২০২৫। সকাল সাড়ে ছয়টা। দিনটি বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। এইদিন নতুন করে একটি ইতিহাস লিখিত হলো। পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল দাঁড়িয়ে আছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। তার মাথার ওপরে বিশুদ্ধ নীল আকাশ থাকার কথা ছিল কিন্তু প্রকৃতি সেটি চায়নি। চেয়েছিল চরম পরীক্ষা। পায়ের নিচে ছিল অসীম শূন্যতা। ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে শাকিল শুধু একজন পর্বতারোহী নন; তখন হাজারো আবেগ, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্বপ্নের প্রতিনিধি। তিনি জয় করলেন। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করলেন। মরহুম বাবা খবির উদ্দিনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটালেন।
Advertisement
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের বাগচালা গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান ইকরামুল হাসান শাকিল। ভাঙা ঘরে শুয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন, একদিন এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করবেন। সেই অসাধ্য তিনি সাধন করেছেন। দেশের জন্য বয়ে এনেছেন গৌরব। সপ্তম বাংলাদেশি হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন তিনি। ৮৪ দিনে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে যাত্রা শুরু করে হেঁটে পৌঁছে গেছেন এভারেস্টের চূড়ায়। মাঝখানে সাঁতরে পার হয়েছেন যমুনা নদী। সবাই হয়তো তার সাফল্যের সংবাদটাই দেখেছেন। এর পেছেনে লুকিয়ে থাকা অনেক অজানা কাহিনি শুধু শাকিল আর তার শুভাকাঙ্ক্ষীরাই জানেন।
ছোটবেলায় খেলাধুলা ও ছবি আঁকায় পারদর্শী ছিলেন শাকিল। ছাত্র হিসেবেও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবুও জীবনযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন অকুতোভয় সৈনিক হয়েই। কারো কাছে করুণা ভিক্ষা করেননি কখনো। পরিশ্রমকে বেছে নিয়েছেন সফলতার চাবিকাঠি হিসেবে। উত্তরার আব্দুল্লাহপুরের পাইকারি মাছের বাজারে ভোরবেলায় কাজ করেছেন। এক পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীর সাথে। তার কাজ ছিল মাছের বক্সগুলো ট্রাক থেকে অন্যদের সাথে নামানো। নামানো শেষ হলে খুচরো ব্যবসায়ীদের মেপে বুঝিয়ে দেওয়া। কাজ শেষ করে মেসে ফিরে গোসল করে কলেজে যেতেন ক্লাস করতে। ক্লাস শেষে খন্দকার পেট্রোল পাম্পের পাশের দোকানে দুটি সিঙারা খেয়ে চলে যেতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে। তিনি পদাতিক নাট্য সংসদ বাংলাদেশের সাথে থিয়েটারে কাজ করছেন ২০১১ সাল থেকে। টিএসসিতে নাটকের মহড়া শেষ করে রাতে মেসে ফিরতেন। তখনো বনানী আর কুড়িল ফ্লাইওভার হয়নি। যদি ফাল্গুন পরিবহনে যেতেন; তখন কুড়িল বিশ্বরোড আর বনানী হয়ে গেলে বনানী রেলক্রসিংয়ে দীর্ঘসময় ট্রেনের সিগন্যালে বসে থাকতে হতো। রাত ১১-১২টা বেজে যেত মেসে ফিরতে।
বাড়ি থেকে বাবা যে টাকা দিতেন, তা শুধু সেমিস্টার ফি দিতেই হিমশিম খেতে হতো শাকিলের। বাড়তি টাকা পেতেন না। তাই মেসের ভাড়া, খাবার ও ব্যক্তিগত খরচের টাকা নিজেকেই জোগাড় করতে হতো। নিম্নমধ্যবিত্তের উচ্চবিলাসী স্বপ্ন নিয়ে প্রাইভেটে পড়ালেখা করলে যা হয় আরকি। সেজন্য মাছের বাজারে, সুপারশপে, রংমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে, ভলেন্টিয়ারিং, বিনোদন ম্যাগাজিনে, সাপ্তাহিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে হয়েছে। তখন কাজটাই প্রধান আর পড়ালেখা অপশনাল হয়ে গিয়েছিলো। ক্লাসে সবার থেকে কম উপস্থিতি ছিল শাকিলের। এমনো হয়েছে পুরো সেমিস্টারে কোনো সাবজেক্টে মাত্র দুটি ক্লাস করেছেন। তবে কখনো পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করেননি। তিনি কখনো সবগুলো বই কিনতে পারেননি। নতুন বই তো কেনার কথা চিন্তাও করতে পারেননি।
Advertisement
শাকিল তখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাঝখানে বছর তিনেক পড়াশোনায় বিরতি দিয়ে পুনরায় উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। যেহেতু সব খরচের টাকা-পয়সা নিজেকেই জোগাড় করতে হয় এবং হবে। তাই সেই টাকা জোগাড় করতেই এই বিরতি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, তাই খরচও বেশি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে স্পেশাল ছাড়ও দিয়েছিল তার কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে। শাকিল ছোট ভাইকেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন। তার খরচের অর্ধেক শাকিলের বাবাই জীবিত থাকা পর্যন্ত দিতেন। বাকিটা শাকিলকেই ম্যানেজ করতে হতো।
শাকিল তখন চাকরি করেন একটি সুপারশপে। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বা দুপুর ১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। এখানে তিনি ফিশ অ্যান্ড মিট ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছেন। তার কাজ ছিল ক্রেতারা যে মাছ কিনতেন; সেগুলোর আঁশ ছাড়িয়ে কেটে দেওয়া। সিঁড়ির নিচে ছোট একটা জায়গা ছিল; সেখানে বসে বসে সারাদিন মাছ কাটতেন শাকিল। তাই ক্লাসে একমাত্র তিনিই অনিয়মিত। যে কারণে শিক্ষকেরা চিনতেনই না। ক্লাসে গেলে জিজ্ঞেস করতেন, শাকিল স্টুডেন্ট কি না। শিক্ষক ও সহপাঠীরা ভাবতেন, সে ইচ্ছে করেই ক্লাসে অমনোযোগী। তাই খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। এক শিক্ষক পরীক্ষার আগে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, ‘এই ফাজিল ছেলেটা ক্লাসে কেন, দুদিন পরে পরীক্ষা। পরীক্ষায় কী লিখবে, অন্যেরটা দেখে লেখার সুযোগ আমি দেবো না। প্রতিটা ক্লাসে যে সিটগুলো দিয়েছি; সেগুলো তোমাকে দিয়ে তো লাভ নেই।’ সত্যি লাভ হয়নি। যদিও পাস মার্ক টেনেটুনে উঠেছিল।
আরও পড়ুন
দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে কেমন ছিল শাকিলের প্রথম অভিযানআমরা জানি, ক্লাসের গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্টের প্রেজেন্টেশনে ফর্মাল ড্রেস পড়তে হয়। নয়তো প্রেজেন্টেশনে দাঁড়াতে দেবেন না বলে আগেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন শিক্ষক। শাকিলের তো কোনো ফর্মাল ড্রেস নেই। নতুন কিনবেন কীভাবে? যে টাকা পান, তাতে অ্যাকাডেমিক ফি দিলে থাকা-খাওয়ায় বাকি থাকে। থাকা-খাওয়ার টাকা দিলে অ্যাকাডেমিক ফি বাকি থাকে। এভাবেই চলছিলো। কখনো বন্ধুদের আড্ডায় থাকতে পারেননি। থাকলেই খরচ শেয়ার করতে হতো তাই। যে কারণে শাকিলের বন্ধুও তেমন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্টের আগের দিন আনোয়ার নামের এক পরিচিত ভাইয়ের লন্ড্রি থেকে একটি কালো টাই আর সাদা শার্ট ভাড়া করলেন শাকিল। জুতা পাশের রুমের জিহাদের কাছ থেকে নিলেন। যদিও সাইজে একটু বড় হয়েছিল। প্যান্ট—এই একটামাত্র জিনিসই নিজের ছিল সেদিন। যদিও তাকে সেদিন প্রেজেন্টেশন দিতে দেওয়া হয়নি। তিনি অনিয়মিত ছাত্র ছিলেন বলে। যেহেতু গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তাই তাকে প্রেজেন্টেশন মার্ক থেকে বঞ্চিত করেননি শিক্ষক।
Advertisement
লেখালেখির অভ্যাসও আছে শাকিলের। কবিতা লিখেছেন, মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রতিটি অভিযানের কাহিনি লিখেছেন। ছয়টির বেশি বইও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পর্বত অভিযান নিয়ে। বই বিক্রির কিছু টাকায় দিন যাপন করেছেন। হাসিমুখেই মেনে নিয়েছেন জীবনযুদ্ধ। জীবনের এতসব প্রতিবন্ধতা পার হওয়ার পরও এভারেস্ট জয়ের পরতে পরতে ছিল বিপদের হাতছানি। এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে যাওয়ার পথে একাধিক পর্বতারোহীর মৃতদেহ দেখেছেন। একসময় মানসিকভাবে ভেঙেও পড়েছিলেন। তবে হাল ছেড়ে দেননি শাকিল। যেদিন চূড়ায় উঠলেন, সেই মুহূর্তে কোনো অনুভূতি ছিল না তার। শুধু মনে হচ্ছিল, দেশের পতাকা উড়িয়েছেন, এখন বেঁচে ফিরতে হবে নিচে। কারণ আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না তখন।
২৯ মে বিকেল চারটা চল্লিশ মিনিটে শাকিল বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা রাখেন। আগের রাতে শাকিলের সঙ্গে কথা হয় আমার। এভারেস্ট জয় করার পরও তার মন বিষাদে ছেয়ে আছে। স্বপ্ন তো পূরণ হলো, এবার জীবন চলবে কীভাবে? শাকিল জানালেন, এই মুহূর্তে তিন-চার লাখ টাকা ঋণী আছেন নেপালে। এক শুভাকাঙ্ক্ষীকে কিছু টাকা নিয়ে বিমানবন্দরে আসতে বলেছেন। কথাটি বলে হাসছিলেন। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘বলতে পারেন বাংলাদেশের বিমানবন্দরে নামবো একদম খালি হাতে।’ আরও জানালেন, এ মুহূর্তে ঢাকায় তার কোনো বাসা নেই। অভিযানে যাওয়ার আগে যে বাসায় থাকতেন; সেটিও ছেড়ে দিয়েছেন। ঢাকায় পৌঁছে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কোথায় থাকবেন। হয়তো আবার নতুন বাসা খুঁজতে হবে। দু’তিন দিন হয়তো এদিক-সেদিক থাকা যাবে। আর্থিক সংকট কেটে গেলে নিজের একটি থাকার জায়গা হয়তো হবে।
বিমানবন্দরে অভিবাদনের পর একটি হোটেলে তার অভিযানের পৃষ্ঠপোষক প্রাণ গ্রুপ সংবর্ধনা দেয়। সেখানে শাকিলের মা-ও এসেছিলেন কালিয়াকৈর থেকে। শাকিলের মা শিরিন আকতারের ভালোবাসা ও বিশ্বাস দেখে সেদিন অবাক হয়ে গেছেন সবাই। ছেলের কাছে তার কোনো আবদার নেই। চাওয়া-পাওয়া নেই। তিনি শাকিলকে কখনো পর্বতারোহণের কাজে বাধা দেননি। বরং বার বার উৎসাহ দিয়েছেন। নিজে কষ্ট করে, চাষাবাদ করে সংসার চালিয়েছেন। স্বামী খবির উদ্দিন মারা যাওয়ার পর শাকিলের সঙ্গে তিনিও সংসারের হাল ধরেছেন। শাকিল হোটেলে প্রবেশের পর ‘আমার পাগল আয়া পড়ছে’ বলে শিরিন আকতার যেভাবে দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে বুকে টেনে নিয়েছেন, সেই দৃশ্য সবাইকে আপ্লুত করেছে। চোখে জল এনেছে।
৩১ মে শাকিলের গ্রামের বাড়িতে বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করেছে গ্রামবাসী। ব্যান্ড বাজিয়ে, ফুলের মালা দিয়ে নেচে-গেয়ে তারা শাকিলকে বরণ করেছেন। বয়স্করা জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদে ফেলেছেন। মাটির ঘরের সন্তান শাকিল বিশ্বজয় করে তিন তিনটি রেকর্ড নিয়ে অনুন্নত গ্রামে ফিরেছেন। গর্বে তাদের হৃদয় প্রশস্ত হয়ে উঠেছে। শাকিলের বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন তিনি। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতেন। বাবার অবর্তমানে গ্রামের মানুষগুলোই শাকিলকে বুকে টেনে নিয়েছে। গর্বিত হয়েছে। ভালোবাসার পরশে পরবর্তী অভিযানের জন্য সাহস জুগিয়েছে। অভিনন্দন শাকিল! আপনার সব আশা পূরণ হোক। বাংলাদেশের সম্মান ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়।
এসইউ/এমএস