২০২৫ সালে ভারতের রাজনৈতিক মহলে দেখা গেলো এক নাটকীয় বাঁক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটি গত ৩০ এপ্রিল ঘোষণা করেছে, আসন্ন জনগণনার মধ্যে জাতিগত (কাস্ট) হিসাব অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই সিদ্ধান্ত আরএসএস বা সংঘ পরিবার-সমর্থিত ঐতিহ্যবাহী অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। আগে তারা বলতেন, জাতিগত শুমারি হিন্দুদের বিভক্ত করবে।
Advertisement
২০২৩ সালের মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানের রাজ্য নির্বাচনে বিজেপির জয়ের পর, কংগ্রেসের জাতিগত শুমারি-ভিত্তিক প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় মোদী বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ দেশকে জাতপাতের ভিত্তিতে ভাগ করার চেষ্টা করেছে। আমার কাছে চারটি জাত আছে—নারী, যুব, কৃষক ও গরিব।’ এর দুই বছর আগে লোকসভায় এক প্রশ্নোত্তরে সরকার বলেছিল, তফসিলভুক্ত জাতি ছাড়া অন্য কোনো জাতি গণনায় সরকারের আগ্রহ নেই।
তবে এখন কেন এই ইউটার্ন?
বিহারের রাজনীতি ও জাতীয় চাপএর প্রধান কারণ বিহারের নির্বাচন। এই রাজ্যে জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট বহু দশক ধরে গুরুত্বপূর্ণ। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এরই মধ্যে ২০২২ সালে একটি জাতিগত সমীক্ষা করেছেন। তার দল জেডিইউ পার্লামেন্টে বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। এই সমীক্ষার পর একটি পূর্ণাঙ্গ জাতিগত শুমারি না হলে বিরোধী জোট—বিশেষ করে কংগ্রেস-আরজেডি—বিষয়টি ইস্যু করে ফায়দা তুলতে পারতো। তাই বিজেপি এখন দাবি করছে, মোদীর সিদ্ধান্ত ছিল ‘কৌশলগত’।
Advertisement
আরও পড়ুন>>
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন/ গুজরাট মডেলে ভারত চালাতে চান মোদী পাওনা আটকে রাখায় মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তামিলনাড়ুর মামলা চীন-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে আশাভঙ্গ ভারতের, অধরাই থাকবে ‘বিশ্ব কারখানা’র স্বপ্ন?বিজেপি বলছে, স্বাধীনতার পর কংগ্রেস সরকার কোনোবারই জাতিগণনা করেনি, যা সত্য নয়। ২০১১ সালের জনগণনায় জাতি অনুসারে তথ্য সংগ্রহ হয়েছিল, কিন্তু মোদী সরকার সেই তথ্য প্রকাশ করেনি।
মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্ণ—সংকুচিত সুবিধাভোগী শ্রেণিমোদী সরকারের সিদ্ধান্তের পেছনে আরও গভীর সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন রয়েছে। উচ্চবর্ণের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা একসময় বিজেপির প্রধান ভিত্তি ছিল, তারা এখন বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক মন্দায় চাপে রয়েছে। সংরক্ষিত চাকরি কমে গেছে, সরকার ‘উচ্চবর্ণের দরিদ্রদের’ জন্য ১০ শতাংশ ইডব্লিউএস কোটা চালু করলেও বাস্তবে সংরক্ষণ-ভিত্তিক সুবিধা কমেছে।
ফলে বহু ‘নিও-মিডল ক্লাস’ যারা ‘নতুন আগত’ এবং ‘নিম্নবর্ণ’—তারা জাতিগত ভিত্তিতে সুযোগ পেলে সেটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখবে।
Advertisement
মোদী এখন আর কেবল উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্তের ওপর নির্ভর করছেন না। লোকনীতি-সিএসডিএস জরিপ অনুযায়ী, বিজেপিকে ভোট দেওয়া গরিব ভোটারের হার ২০০৯ সালে ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ৩৭ শতাংশ হয়েছে। এখন ধনী ও গরিব সমর্থকদের মধ্যে ভোটের পার্থক্য মাত্র ৪ শতাংশ।
মোদী এই শ্রেণিকে টানতে চেয়েছেন ‘সম্মানের রাজনীতি’র মাধ্যমে—নিজের শ্রমজীবী পরিচয় সামনে এনে এবং নানা ‘প্রধানমন্ত্রী’-নামাঙ্কিত কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করে। সিএসডিএস দেখায়, যারা এসব প্রকল্পে সুবিধা পেয়েছে, তারা বিজেপিকে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ধর্ম বনাম জাতি: বিজেপির কৌশলগত দ্বৈতনীতিধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে বিজেপি বহু আগে থেকেই হিন্দু নিম্নবর্ণ ভোটারদের নিজেদের দিকে টানছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে সিএসডিএস জরিপে দেখা গেছে, মুসলিমবিরোধী মনোভাব ‘উচ্চ’ এবং ‘নিম্ন’ হিন্দু জাতিগোষ্ঠীতে প্রায় সমান। উদাহরণস্বরূপ, দলিতদের মধ্যে ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ মনে করে মুসলিমরা ‘বিশ্বস্ত নয়’।
তবে বিজেপির অভ্যন্তরেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দলটি এখনো ‘উচ্চবর্ণ-প্রধান’। ২০২৪ সালে এনডিএ-মনোনীত প্রার্থীদের ৩১ শতাংশ ছিল উচ্চবর্ণ, যেখানে ইন্ডিয়া জোটে তা ছিল ১৯ শতাংশ। যদি বিজেপি ‘নিম্নবর্ণ’ ভোট টানার জন্য টিকিট বণ্টনে বদল আনে, তাহলে দলীয় নেতাদের মধ্যেই আপত্তি উঠতে পারে।
আরও একটি সমস্যা—২০২৪ সালে বিজেপি ‘নিম্ন’ ওবিসিদের বেশি ভোট পেয়েছে, কারণ বিরোধীরা তাদের অবহেলা করেছে। তবে উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি এক ব্যতিক্রমী কৌশল নেয়: কিছু সংখ্যক যাদব প্রার্থী দিয়ে ‘নিম্ন’ ওবিসিদের বেশি টিকিট দেয়। এতে যাদবরা ক্ষিপ্ত না হয়ে দলেই থাকে, আবার নতুন ভোটারও আসে। বিহারে কংগ্রেস-আরজেডি যদি এই কৌশল অনুসরণ করে, তাহলে মোদীর ‘জাতি শুমারি কার্ড’ অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
লেখক: ক্রিস্টফ জ্যাফরেলো, প্যারিসের সিয়েন্স পোর সিইআরআই-সিএনআরএসে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, কিংস কলেজ লন্ডনে ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজবিদ্যার অধ্যাপক এবং ব্রিটিশ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান।
সূত্র: দ্য ওয়্যারকেএএ/