ফিচার

গ্রামীণ বাংলার বিলুপ্তপ্রায় খেলা

গ্রামীণ বাংলার বিলুপ্তপ্রায় খেলা

সানজানা রহমান যুথী

Advertisement

খেলা ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি বিষয়। কিন্তু কালের বিবর্তনে খেলার ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। গ্ৰামে একসময় প্রচলিত ছিল কিতকিত, বৌছি, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, পাঁচগুটি, ১৬ গুটি, গোস্তচুরি, এলোনটি-বেলোনটি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের খেলা। খেলাগুলোর নাম শুনতে হাস্যকর শোনালেও গ্ৰামবাংলার একসময়কার এসবই ছিল জনপ্রিয় খেলা।

স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে অথবা স্কুল ছুটির শেষে ছেলেমেয়েরা এসব খেলায় মেতে উঠতো। আর ছুটির দিন হলে তো কথাই নেই ছোট ছেলেমেয়েরা সারাদিনই খেলতো। অন্যদিকে বড়রা তাদের অবসর সময়ে বিকালে খেলার আসর জমায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় গ্ৰামবাসীরা কোনো বিশেষ দিনে গ্ৰামবাসীরা খেলার আয়োজন করতো। তা দেখার জন্য উৎসুক জনতার ভিড় জমে যেত।

তবে আজ এসব খেলে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামেও আজকাল ছোট বাচ্চারা এসব খেলা খুব একটা খেলে না। সবাই মগ্ন স্মার্টফোনে। তারপর আবার পড়ার চাপ, খেলার জায়গা কমে যাওয়া সহ নানান অজুহাত তো আছেই। চলুন আজ এমনই কিছু গ্ৰামীণ খেলার কথা জেনে নেয়া যাক। যেগুলোর সঙ্গে নব্বই দশকের যারা আছেন খুব ভালো স্মৃতি মনে করতে পারবেন।

Advertisement

পাঁচগুটিপাঁচগুটি খেলা নব্বই দশকের ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। এ খেলায় সাধারণত পাঁচটি ছোট ছোট পাথরের গুটি ব্যবহার করা হয়। এ খেলাটি সাধারণত কয়েকটি ধাপে পরিচালিত হয়। এই খেলায় প্রথমে গুটি পাঁচটিকে হাতে নিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে ফেলা হয়। এরপর একটি গুটি হাতে তুলে নিয়ে ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ার আগেই মাটিতে ছড়িয়ে থাকা যে কোনো একটি গুটি তুলে নিয়ে ওপরে ছুঁড়ে দেওয়া গুটিও হাতে নিতে হয়। এরপর দুটি করে। এভাবে গুটি খেলা একা থেকে শুরু হয়ে পঞ্চমে গিয়ে শেষ হয়।

বৌচিবৌচি গ্ৰাম বাংলার মেয়েদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। এই খেলা সাধারণত দুই দলের মধ্যে সংগঠিত হয়ে থাকে। ১০-১৫ জন হলেই বৌচি খেলা যায়। এই খেলায় দুটি দলে সমান সমান খেলোয়াড় থাকে। টসের মাধ্যমে যে দল উত্তীর্ণ হয় , সেই দল খেলা শুরু করে। অন্যদিকে অপর দল প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করে। এই খেলায় টসে উত্তীর্ণ দল থেকে একজনকে বৌ নির্বাচিত করা হয়। সাধারণত বৌচি খোলা মাঠ বা উঠানে খেলা হয় এবং টসে উত্তীর্ণ দলের নির্দিষ্ট ঘর থাকে। একইসঙ্গে বৌয়ের জন্য অপরপ্রান্তে আরেকটি ঘর রাখা হয়। বৌকে নিজেদের ঘরে আনার জন্য টসে উত্তীর্ণ দলের সদস্যরা একে একে দম দিয়ে বৌকে নিয়ে আসে। এসময় প্রতিপক্ষ দলের সদস্যরা ঘরের বাইরে অবস্থান করে। দম দেওয়া অবস্থায় যদি প্রতিপক্ষ দলের কাউকে ছুঁয়ে ফেলে তাহলে সে আউট হয়ে যায়। একইভাবে বৌ নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিপক্ষ দলের কেউ বৌকে ছুঁয়ে দিলে পুরো দল আউট হয়ে যায় এবং প্রতিপক্ষ দল খেলার সুযোগ পায়। আর যদি বৌকে দম দিয়ে নির্দিষ্ট ঘরে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে তারা ১ পয়েন্ট করে জিতবে।

এলোনটি-বেলোনটিনাম শুনেই বোঝা যায় এলোনটি-বেলোনটি খুব মজার একটি খেলা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই খেলা এখনো বেশ জনপ্রিয়। ৭-১০ জন হলেই এলোনটি-বেলোনটি খেলা যায়। এই খেলা খেলার জন্য প্রথমে সবাই একে একে হাত মিলিয়ে উত্তীর্ণ হলে কেউ না কেউ অনুত্তীর্ণ থেকে যায় এবং তাকে কেন্দ্র করেই এলোনটি-বেলোনটি খেলা পরিচালনা করা হয়।

যারা উত্তীর্ণ তারা একপ্রান্তে থাকে এবং যে অনুত্তীর্ণ সে ওপরপ্রান্তে থাকে। এবার সে এলোনটি-বেলোনটি, ঘড়ি বাজে টিন টিন। এক, দুই, তিন ছড়া কাটতে থাকে এবং সেই সময়ের মধ্যে বাকিরা সবাই প্রতিপক্ষকে ছুঁতে সামনে এগিয়ে আসতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত যে অনউত্তীর্ণ সে পিছন ফিরে না তাকায় এটাও। ছড়া বলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি কেউ স্থির না থাকে তাহলে সে আউট যায় এবং সে অনুত্তীর্ণ হয়, আর অনুত্তীর্ণ জন উত্তীর্ণ হয়। এভাবে যখন সবাই প্রতিপক্ষজনের কাছে চলে যায় তখন তাকে ছুঁয়ে দৌড়ে তাদের নির্দিষ্ট ঘরে চলে যায় এর মাঝে যদি প্রতিপক্ষ তাকে ধরে ফেলে তাহলে সেও আউট যায় না এবং তাকে নিয়ে একইভাবে খেলা পরিচালিত হয়।

Advertisement

কিতকিতকিতকিত বা কুতকুত, এখনো ছোট মেয়েদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। কিতকিত খেলা কোনো কোনো এলাকায় এক্কা-দোক্কা হিসেবেও পরিচিত। এই খেলা একাকি বা একাধিক খেলোয়াড় নিয়েও খেলা যায়। কিতকিত খেলার প্রধান উপকরণ হলো চাড়া। যা ভাঙা মাটির হাড়ির ছোট একটি অংশ দিয়ে তৈরি করা হয় এবং মাটিতে ছক কেটে এই খেলা পরিচালনা করা হয়। এই খেলায় এক থেকে পাঁচ ঘর পর্যন্ত ছক কাটা থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচের অধিকও ঘর থাকে। এ খেলায় প্রথমে চাড়া এক নম্বর ঘরে ফেলে তারপর ডান পা একটু উঁচু করে বাম পা দিয়ে ক্রমানুসারে সব ঘর পাড় করতে হয়। কোনো ক্রমে যদি খেলোয়াড়ের চাড়া ঘরের দাগের মধ্যে পড়ে যায় তাহলে খেলোয়াড় তার দান হারান। এরপর অন্য খেলোয়াড় খেলতে থাকেন।

পানি ঝুপ্পাগ্ৰাম বাংলার ছেলেদের মাঝে অন্যতম জনপ্রিয় খেলা হলো পানি ঝুপ্পা। খেলার নাম শুনেই বোঝা যায় খেলাটি সাধারণত পানিতে খেলা হয়। পানি ঝুপ্পা খেলা একাকি কিংবা কয়েকজন মিলেও খেলা যায়। পানি ঝুপ্পাতে মাটির পাতলা ভাঙা চাড়া ব্যবহার করা হয়। এরপর এই চাড়া হাতের কৌশলে পানিতে এমনভাবে ফেলা হয় যে চাড়াটি ব্যাঙের মতো লাফাতে থাকে। পানি ঝুপ্পা সাধারণত পুকুরে, খাল-বিল, নদীতে খেলা হয়। একাকি খেলার চেয়ে এই খেলা কয়েকজন মিলে খেললে বেশি মজা হয়। কার চাড়া কতটুকু লাফাল, কতদূর গেল এভাবে প্রতিযোগিতা করে পানি ঝুপ্পা খেলা হয়।

ফুলটোক্কাফুলটোক্কা ছোট ছেলেমেয়েদের মাঝে এখনো বেশ জনপ্রিয়। এই খেলা দুই দলের মধ্যে হয়ে থাকে। দুই দলে দুইজন রাজা থাকে। খেলার শুরুতে রাজা তাদের সদস্যদের বিভিন্ন ফুলের নামে নাম রাখেন। এ খেলায় দলপতি তার বিপক্ষ দলের যে কোনো একজন খেলোয়াড়ের হাত দিয়ে তার চোখ বন্ধ করে দেয়। এরপর দলপতি তার দলের যে কোনো খেলোয়াড়কে সাংকেতিক ফুলের নামে ডাকে। তখন যে খেলোয়াড় আস্তে করে অপর পক্ষের চোখ বন্ধ করে রাখা খেলোয়াড়ের কপালে টোকা দিয়ে নিজের স্থানে চলে যায়। এরপর চোখ খোলার পর ঐ খেলোয়াড় যে টোকা দিয়েছে তাকে শনাক্ত করতে পারে তাহলে সে সামনের দিকে লাফ দেয়ার সুযোগ পায়। এভাবে পালাক্রমে দুই দলের মধ্যে খেলা পরিচালনা করা হয়। যে দলের খেলোয়াড় মধ্যবর্তী সীমানা আগে পেরুতে পারে তারা বিজয়ী হয়।

মাংস চুরিমাংস চুরি গ্ৰামের মেয়েদের কাছে খুবই পরিচিত একটি খেলা। ছোট মেয়ে থেকে কিশোরী সব মেয়েরাই এই খেলা খেলে। মাংস চুরি খেলা দুই দলের মধ্যে হয়ে থাকে। দুই দলেই সমান সমান সদস্য থাকতে হয়। এই খেলায় একদলের কাছে কয়েকটা ইটের টুকরা থাকে যাকে মাংস বলে অভিহিত করা হয়। তখন অন্যদলের যে কোনো খেলোয়াড় দম দিয়ে বিপক্ষ দলের কাছ থেকে মাংস নিয়ে আসতে চায়। যদি দম দিয়ে বিপক্ষ দলের কাছ থেকে মাংস নিজেদের ঘরে আনতে পারে তাহলে তারা এক পয়েন্ট করে পায়। আর যদি মাংস নিয়ে যাওয়ার সময় ধরে ফেলে তাহলে সে খেলোয়াড় তার দান হারান। এভাবে দুই দলের মধ্যে মাংস চুরি খেলা হয়।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মজার খেলাগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রযুক্তির এই সময়ে বাচ্চা থেকে কিশোর-কিশোরীরা এখন মোবাইল ফোনে আসক্ত। তাই এসব খেলাও এখন তেমন আর খেলা হয় না । কিন্তু এসব খেলা শুধু আনন্দই দেয় না, শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুদের সার্বিক উন্নয়নের খেলাধুলা এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই আমাদের উচিত এসব গ্ৰাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখা।

আরও পড়ুন গাছের ভাষায় প্রকৃতির পাঠশালা  পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম বানিয়ে সফল রাজু 

কেএসকে/জিকেএস