ফাহিম হাসনাতঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী, তার আধুনিক রূপের পাশাপাশি একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষী। আর এই ইতিহাসের চিত্র আজও ফুটে ওঠে পুরান ঢাকার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থানে। পুরান ঢাকা, যা শহরের প্রাচীনতম এলাকা, সেখানে এখনো বিদ্যমান নানা স্থাপনা ও স্মৃতিচিহ্ন সেই সময়ের গৌরবময় ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়।
Advertisement
পুরান ঢাকা একসময় প্রাচীন মোঘল আমল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ এবং পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখানে অবস্থিত বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো সেই সময়ের ইতিহাস, স্থাপত্যশিল্প এবং সংস্কৃতির মিশেল।
পুরান ঢাকা একটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক নগরী, যেখানে যুগ যুগ ধরে নানা ধারা ও সংস্কৃতির সমাহার ঘটেছে। এর ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো শুধু ঢাকার নয়, পুরো বাংলাদেশের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির অন্যতম মূল্যবান নিদর্শন। পুরান ঢাকা আমাদের শেকড়ের সঙ্গে এক গভীর সম্পর্ক তৈরি করে, যা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতিকে সযত্নে ধারণ করে রাখে।
পুরান ঢাকা গঠিত বেশ কয়েকটি জায়গা নিয়ে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং ঐতিহাসিক কয়েকটি স্থান সম্পর্কে আসুন জেনে নেওয়া যাক-চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার
Advertisement
সুত্রাপুরএটি ঢাকার একটি অপরিচিত স্থান হলেও সুত্রাপুর একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল। এক সময় এখানে ঢাকার প্রথম রেলওয়ে স্টেশন ছিল, যা ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও এখানের সরু গলি, পুরোনো রাস্তা এবং বাজার এক বিশেষ অনুভূতি তৈরি করে, যেখানে আপনি প্রাচীন ঢাকা দেখতে পাবেন।
আহসান মঞ্জিলঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ভবন, যা মূলত ১৮৫৯ সালে নির্মিত হয়। এটি একসময় ঢাকার নবাবদের বাসভবন ছিল এবং মোঘল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। ভবনটি ত্রিমাত্রিক এবং রঙিন কাঁচের জানালা, সুউচ্চ ছাদ ও অপূর্ব নকশায় সুসজ্জিত। বর্তমানে আহসান মঞ্জিল একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে ঢাকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নবাবদের জীবনযাত্রা সম্পর্কিত নানা প্রদর্শনী রয়েছে।
সদরঘাটঢাকার একটি ঐতিহাসিক স্থান, যা মোঘল আমল থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও পরিবহন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ১৭৭৮ সালে ব্রিটিশ শাসনের সময় এটি বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ঢাকার বাণিজ্যিক প্রবাহের প্রধান মাধ্যম ছিল। বর্তমানে ঢাকা শহরের বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত।
বাহাদুর শাহ পার্কপুরান ঢাকায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক উদ্যান। এটি ঢাকা শহরের অন্যতম প্রাচীন পার্ক, যা ১৮৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বাহাদুর শাহ জাফর, শেষ মোঘল সম্রাটের নামে নামকরণ করা হয়। পার্কটি মূলত ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে নিহত অনেক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পাবলিক পার্ক, যেখানে মানুষের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে।
Advertisement
মুকুন্দপুরপুরান ঢাকার একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, যেখানে মোঘল আমলে তৈরি বিভিন্ন স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে। এখানে প্রাচীন সময়ের হিন্দু মন্দির, গোপালপুর জমিদার বাড়ি এবং মসজিদগুলো পুরান ঢাকার পুরোনো দিনের সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
চকবাজারএটি পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী এবং জনপ্রিয় বাজার। একসময় এটি ঢাকার বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবেও বিখ্যাত ছিল। এখানে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন ফুচকা, চিঁড়ে মিষ্টি, বিরিয়ানি, কাবাব, পিঠা ইত্যাদি পাওয়া যায়। চকবাজার শুধু যে একটি বাজার, তা নয়, এটি ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক রূপের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
আহসান মঞ্জিল
পোগোজ স্কুলএটি ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত, যা ঢাকার অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য ছাত্র হলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান, গিরিশ চন্দ্র সেন, কবি শামসুর রহমান প্রমুখ।
লালবাগ কেল্লাপুরান ঢাকার অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক স্থান হলো লালবাগ কেল্লা। ১৬৭৮ সালে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শায়েস্তা খান এই দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গটি নানা মোঘল স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য রত্ন। এর চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দালান এবং মসজিদ, যার মধ্যে অন্যতম সঙ্গীত মন্দির, দুর্গের মসজিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ।
বেগম বদরুন্নেসা স্কুলএটি পুরান ঢাকার এক ঐতিহাসিক স্কুল যা ১৯শ শতকের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। নারী শিক্ষা এবং সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি একটি মাইলফলক। পুরান ঢাকার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শুধু একটি স্কুল নয়, এটি নারীদের সমাজে নতুন করে পথ দেখানোর উৎস।
ইসলামপুরপুরান ঢাকার ইসলামপুর একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকা, যা তার বাজার এবং সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। ইসলামপুর মূলত একটি পুরোনো এবং ব্যস্ত বাণিজ্যিককেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিভিন্ন পণ্য যেমন কাপড়, মসলিন এবং অন্যান্য হস্তশিল্পের পণ্য বিক্রি হয়।
খিদিরপুর মসজিদপুরান ঢাকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো খিদিরপুর মসজিদ। এই মসজিদটি বিশেষভাবে পরিচিত তার নকশার জন্য এবং এটি ঢাকার ইসলামী স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
সদরঘাট
জাহাজ কোম্পানি মসজিদপুরান ঢাকার জাহাজ কোম্পানি মসজিদ একটি ঐতিহাসিক মসজিদ, যা মোঘল আমলের স্থাপত্যের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই মসজিদটির চারপাশে কিছু প্রাচীন ভবন রয়েছে, যা ঢাকার ঐতিহাসিক নগর স্থাপত্যের বিশেষ নিদর্শন।
নবাবপুরএটি পুরান ঢাকার অন্যতম বিখ্যাত বাণিজ্যিক এলাকা, যেখানে নানা ধরনের দোকান এবং ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে।
হোসেনি দিঘীএটি একটি ঐতিহ্যবাহী জলাশয়, যা পীরের মাজার এবং ইসলামী ইতিহাসের এক অঙ্গ।
এছাড়াও এখানে আরও বিভিন্ন ঐতিহাসিক মসজিদ, দরগা, হাট, এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রয়েছে। এসব স্থাপনা শহরের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
আরও পড়ুনরোদ-ধুলার শহরে হারিয়ে যাচ্ছে ছায়াবৃষ্টি ভেজা রাস্তায় ভাজা স্বাদের টানলেখক: ফিচার ও কলাম লেখক
কেএসকে/জেআইএম