ছবির ছেলেটির নাম নূর। চোখে তার মায়ার ছায়া, মুখে একরাশ আত্মবিশ্বাস। ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত বহুমুখী কেন্দ্রে সৌর প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে যে দক্ষতা সে অর্জন করেছে, এখন সেটিই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রদর্শন করছে সে। নিঃস্ব হয়ে যাওয়া নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে, হয়েছে আশার প্রতীক। অথচ খুব সহজ ছিল না নূরের এই পথচলা। ছিল না এই স্বপ্ন, এই উঠে দাঁড়ানোর সাহস। যেতে হয়েছে বহু দূর, অতিক্রম করতে হয়েছে অজস্র বাধা-বিপত্তি। ত্যাগ করতে হয়েছে নিজের জন্মভূমি, প্রিয় লোকালয়।
Advertisement
সালটা তখন ২০১৭। মাত্র সাত বছরের শিশু নূর। রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিপীড়নের মুখে পড়ে পরিবারসহ তাকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসতে হয় বাংলাদেশে। সেই দুঃসহ মুহূর্তে তার চোখের সামনে জ্বলছিল নিজ ঘরবাড়ি। চারদিকে ভয়ের করাল ছায়া। নৌকায় করে, পাহাড় পেরিয়ে পাড়ি দিতে হয় এক ভয়াবহ ও বিপজ্জনক পথ। সেই যাত্রার শেষ প্রান্তে আশ্রয় মেলে বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে। তখন থেকেই বাস্তুচ্যুতি নূরের জীবনের অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতায় রূপ নেয়।
আজ ২০ জুন, বিশ্ব শরণার্থী দিবস। যখন আমরা উদ্বাস্তু মানুষদের অধিকারের কথা বলি, তখন নূরের মতো হাজারো শিশুর গল্প সামনে আসে। এই গল্পগুলো কেবল সংখ্যা বা পরিসংখ্যান নয়, এগুলো জীবনের গল্প। বেঁচে থাকার সংগ্রাম, স্বপ্ন দেখা এবং অন্ধকারে আলো খুঁজে ফেরার এক নিরবিচার চেষ্টা। এসব শিশুর শৈশব কেটেছে মাটির ঘরে নয়, বরং প্লাস্টিকের ত্রিপল ঢাকা অস্থায়ী ক্যাম্পে। যেখানে খাবার, শিক্ষা, বিনোদন সবই সীমিত। খেলাধুলা সেখানে বিলাসিতা, আর শিশুশ্রম অনেক সময় বাস্তবতা।
নূরের জীবনেও সেই অন্ধকারের ছায়া পড়েছিল। কখনো মাঠে কাজ, কখনো ভারী বস্তু বহন পরিবারের অর্থনৈতিক চাপে তাকে কর্মে উৎসর্গ করতে হয়েছিল নিজের ছোট্ট জীবনটাকে। প্রথমে সে কিছুই বলত না। হয়তো ভয়, কিংবা বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা থেকে চুপ করে সহ্য করত। কিন্তু একদিন তার এক সহপাঠী তার কঠোর পরিশ্রম দেখে বিষয়টি ফাঁস করে দেয়। তখনই কেস ওয়ার্কারের দৃষ্টিতে আসে তার অবস্থা।
Advertisement
এই অন্ধকারেই আশার আলো হয়ে আসে ইউনিসেফের সহায়তায় পরিচালিত বহুমুখী কেন্দ্র। এই কেন্দ্র শুধু প্রথাগত শিক্ষা নয়, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, মনোসামাজিক সহায়তা, জীবনদক্ষতা প্রশিক্ষণ ও কেস ব্যবস্থাপনার কাজ করে। এখানেই নূরের মাঝে জাগিয়ে তোলা হয় হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস। তার পরিবারকে বোঝানো হয় শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব। কেন্দ্রে কর্মরত কেস ওয়ার্কার সালাউদ্দিনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নূরের বাবার চিন্তাভাবনায় আসে পরিবর্তন। এখন তিনি বিশ্বাস করেন, সন্তানকে মানুষ করলেই ভবিষ্যতে পুরো পরিবার উপকৃত হবে।
বর্তমানে নূরের বয়স ১৫ বছর। সে এখন দক্ষভাবে সৌর প্রযুক্তি ব্যবহার ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ভবিষ্যতে সে নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে কল্পনা করে। তার মুখে ফুটে ওঠে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। সে নিজেই বলে, ‘আগে ভাবতাম আমি কখনো শিক্ষক হতে পারব না। এখন আমি আশাবাদী।’
এই পরিবর্তন কেবল নূরের নয়, এটি হাজারো শিশুর জীবনের গল্প, যারা সহিংসতার মধ্যে জন্ম নিয়েও প্রতিদিন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। নূরের মতো ক্যাম্পে বসবাসরত নারীরাও পিছিয়ে নেই। তারা পাচ্ছেন স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক সহায়তা, সেলাই প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ।
অনেকেই ছোট উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন। পুরুষরাও পাচ্ছেন কারিগরি প্রশিক্ষণ ও স্বেচ্ছাসেবী কাজের সুযোগ। শিক্ষকতা, স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করে তারা নিজেদের কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করছেন।
Advertisement
এই সহযোগিতার অবকাঠামো গড়ে তুলতে বাংলাদেশ সরকার, সশস্ত্র বাহিনী, স্থানীয় জনগণ এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইউনিসেফ, ইউএনএইচসিআর, আইওএম, ডব্লিউএফপি ও আরও অনেক সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছে। এই প্রচেষ্টা শুধুই মানবিকতা নয়, বরং একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতারও প্রমাণ।
আজকের এই দিনে, যখন বিশ্ব বাস্তুচ্যুত মানুষের অধিকারের কথা বলে, তখন নূরের মতো শিশুদের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়...মানবতা কেবল ভাষণে নয়, কর্মেই তার প্রকৃত রূপ পায়। সীমাবদ্ধতার মাঝেও বাংলাদেশ যে মানবিক সহানুভূতি ও দায়িত্বশীলতায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে, তা ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন গাছের ভাষায় প্রকৃতির পাঠশালা রোদ-ধুলার শহরে হারিয়ে যাচ্ছে ছায়াতথ্যসূত্র: ইউনিসেফ বাংলাদেশ
কেএসকে/জিকেএস