ভিডিও EN
  1. Home/
  2. কৃষি ও প্রকৃতি

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে

মামুনূর রহমান হৃদয় | প্রকাশিত: ১২:০০ পিএম, ০৮ জুন ২০২৫

রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারে গাছের শীর্ষে যেন নীল ঝলমলে বিদ্যুতের ফুলকি থ’ মেরে বসে আছে। প্রথম দৃষ্টিতে পাখিটির অবয়বে জেগে ওঠে রহস্য। হঠাৎ ডানা মেলে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। এক ঝলকে জ্বলে ওঠে রঙের আগুন। সেই আগুনে রাতের পর্দায় আঁকে ঝটিকা আলোর অসম্ভব আঁচড়। দীপ্তি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ফ্রেম ফাঁকি দিয়ে তীরের মতো ছুটে নেমে যায় নিচে; শিকারের খোঁজে অদৃশ্য হয়ে যায়। এমনই মোহনীয় এই পাখি আমাদের কাছে পরিচিত ‘নীলকণ্ঠ’ নামে।

বৈজ্ঞানিক নাম ‘কোরাসিয়াস বেনগালেনসিস’। ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়ান রোলার’। পুরো দেহে বাদামি-ছাই ছাপ কিন্তু ডানা-লেজে গাঢ় নীল ও টারকুইজের অপূর্ব মিশেল। উড়ে গেলে প্রাথমিক পালকে চওড়া উজ্জ্বল নীল-কালচে ‘প্যানেল’ চোখে পড়ে। দৈর্ঘ গড়ে ৩০-৩৪ সেন্টিমিটার, ওজন ১৬৬-১৭৬ গ্রাম। চওড়া শক্ত ঠোঁট আর মাঝারি লেজ তাকে ক্লাসিক ‘রোলার’ আকার দেয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি বেগুনি কালা, থোড়মোচা, কেওয়া, নীলাচল, নীলঘুঘু ও নীলকবুতর নামেও পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

নীলকণ্ঠ বৈদ্যুতিক তার, শুকনো ডাল বা খুঁটির মাথায় একা বসে চারদিক পর্যবেক্ষণ করে। শিকার চোখে পড়ামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘাসফড়িং, গোলাপ পোকার দল, ডানাওয়ালা উঁই এমনকি ছোট গিরগিটি-ব্যাঙ ধরতে পারে। ফড়িংয়ের দল দৃষ্টিতে পড়লে ৩০-৪০টি পর্যন্ত নিমিষেই শিকার করে। পোকাখেকো স্বভাবের বলে কৃষিজমিতে ক্ষতিকর পোকা দমন করতে ভূমিকা রাখে। রাতে আলো-আকৃষ্ট পতঙ্গ ধরতে তৎপর। অন্য পাখির চেয়ে বেশ সাহসী। বর্ষায় বা প্রজনন মৌসুমে আকাশে দুর্দান্ত অ্যাক্রোব্যাটিক ঘূর্ণিভঙ্গি (রোল) দেখিয়ে সঙ্গিনীকে আকর্ষণ করে; এজন্যই ‘রোলার’ নামে পরিচিত।

নীলকণ্ঠ সব জেলা-উপজেলার খোলা মাঠ, ফসলি জমি, রেল-সড়কপাশের গাছ, নদীতীর কিংবা বন-জঙ্গলে সহজেই দেখা যায়। উপমহাদেশ ছাড়িয়ে ইরাক থেকে ইন্দো-চীন পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে স্থায়ী বড় ধরনের ঋতুকালীন পরিযায়ন নেই। এরা গাছের প্রাকৃতিক ছিদ্র, কাঠঠোকরার পুরোনো গর্ত বা ইমারতের উঁচু ফাঁকা জায়গায় বাসা বানায়। প্রজনন মৌসুমে ডিম সাধারণত ৪-৫টি পাড়ে; পুরুষ-স্ত্রী পাখি দুজনেই ডিমে তা দেয়। ফোঁটার ১৭-১৯ দিন পর ছানা উড়তে শেখে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

হিন্দু সমাজে এ পাখি শুভ। বিশেষ করে বিজয়া দশমীর দিনে ‘নীলকণ্ঠ দর্শন’ সৌভাগ্যের প্রতীক। গ্রামীণ লোককথায় এর নীল ডানা নীলকণ্ঠ শিবের অনুগ্রহের চিহ্ন। তাই একে মারার কুসংস্কারিক নিষেধ আছে। দ্রুতবেগ ও আকাশ-ঘূর্ণি দেখে বাংলায় ‘বেগুনি কালা’ (রঙের সঙ্গে কালা অর্থ বুড়ি-রোল) নামটি এসেছে।

আইইউসিএনের তালিকায় এ পাখি ‘লিস্ট কনসার্ন’; অর্থাৎ সংখ্যা স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। তবু গাছ কাটার ফলে বাসস্থল হারানো, রাস্তার তারে বিদ্যুৎস্পর্শ, কীটনাশক-দূষিত পোকা খেয়ে বিষক্রিয়ায় পাখিটির মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। নগরায়নের ফলে খোলা জমি ও গাছপালা কমে যাওয়ায় নীলকণ্ঠের দর্শন দিনদিন শহরতলিতে দুর্লভ হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে স্বাভাবিক ভাবে প্রাকৃতিক বিস্তৃতি থাকায় নীলকণ্ঠকে নিঃসন্দেহে ‘দেশি’ পাখি বলা যায়। এটি কোনো খাঁচার বন্দি আমদানি নয়। আমাদের মাঠ, পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য বাসিন্দা। পোকা খেয়ে কৃষকের ক্ষেত বাঁচায়, আকাশে রঙের জলকেলি দেখিয়ে আলোর সৌন্দর্য বাড়ায়। আমাদের লোকালয়ে গর্বের সঙ্গে দেশি নীলকণ্ঠ আছে। নীলকণ্ঠ বাংলার মাটি-জল-আকাশেরই অংশীদার।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন