ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ক্যাম্পাস

স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড সিস্টেম চালু হলে উপকূলীয় কৃষির ক্ষতি কমবে

সোহেল রানা | চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় | প্রকাশিত: ০৫:১৩ পিএম, ২৭ জুলাই ২০২৫

সমুদ্র আমাদের কাছে শুধু মাছের উৎস নয়; এটি জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বার্তা ও খনিজ সম্পদের সম্ভাবনার এক অবারিত ভান্ডার। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে এসেছে উদ্বেগজনক হারে। কিন্তু এ অঞ্চলে সমুদ্রবিজ্ঞান বা ‘ওশানোগ্রাফি’ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা হচ্ছে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষকেরা। দেশে বর্তমানে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে সমুদ্র বিজ্ঞান পড়ানো হলেও প্রয়োজন অনুযায়ী গবেষণা অবকাঠামো ও অর্থায়ন খুবই অপ্রতুল।

বাংলাদেশের এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল রয়েছে, যেখানে বিপুল পরিমাণ প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদ লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের গভীর সমুদ্র গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরে ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ও সুনামির পূর্বাভাসের জন্য সমুদ্রবিজ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও টেকসই মৎস্য আহরণ নীতিমালাও গড়ে তোলা সম্ভব হবে এই গবেষণার মাধ্যমে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপ এরইমধ্যেই ব্লু-ইকোনমিকে গুরুত্ব দিয়ে গবেষণায় বড় বিনিয়োগ করছে। সেখানে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। সমুদ্রবিজ্ঞান প্রসঙ্গে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ওশানোগ্রাফি বিভাগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ অহিদুল আলম

জাগো নিউজ: এই বিভাগে বর্তমানে কী কী গবেষণা কার্যক্রম চলছে?

অহিদুল আলম: আমাদের বেশ কিছু বিষয় গবেষণা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিভাগের উদ্যোগে স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন ছিল কীভাবে আমরা ল্যাবে বসে সমুদ্র মনিটরিং, সমুদ্রে রিসার্চ পর্যবেক্ষণ এবং ফিশিংকে গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে মনিটরিং করতে পারবো। আগামী বছর জুন-জুলাইয়ের মধ্যে শিক্ষামূলকভাবে আমাদের কাজ শুরু হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গ্লোবাল ওয়ার্নিং ও ওয়েভস গরম হয়ে যাচ্ছে। ফলে কোস্টাল কমিটির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে গবেষণাকর্ম চলছে।

কোস্টাল ম্যাপিং ও মাইক্রো প্লাস্টিক পলিউশন নিয়ে কিছু কাজ করছি। সম্প্রীতি চট্টগ্রাম এবং সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভে কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, এসব নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তন অ্যাডাপটেশনের (খাপ খাইয়ে নেওয়া) জন্য ব্লু কার্বন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইকোলজিকাল ইকোসিস্টেম ঠিক রাখার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

আরও পড়ুন:

জাগো নিউজ: শিক্ষার্থীদের জন্য এই বিভাগে কী কী সুযোগ রয়েছে?

অহিদুল আলম: ওশানোগ্রাফি একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সাবজেক্ট। আমরা প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার জন্য আইইএলটিএস, জিআরই, টোফেল পড়তে উদ্বুদ্ধ করি। এই সাবজেক্টে বিদেশে অনেক সুযোগ এবং স্কলারশিপ রয়েছে। কক্সবাজারে একটা ওশানোগ্রাফি রিচার্জ ইনস্টিটিউট রয়েছে, যেখানে একশর কাছাকাছি সায়েন্টিফিক অফিসার পোস্ট আছে। সেখানে আমাদের অনেক শিক্ষার্থী কাজ করে। আরও অনেক গ্র্যাজুয়েট সেখানে কাজ করতে পারবে। পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক তৈরি করেছি, যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা সেখানে মানিয়ে নিতে পারে।

স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড সিস্টেম চালু হলে উপকূলীয় কৃষির ক্ষতি কমবে

সামুদ্রিক স্পেশাল কোস্টাল বেলগুলোতে ওশানোগ্রাফি ছেলেদের কীভাবে প্রোভাইড করা যায়, সেজন্য কাজ করছি। তাছাড়া আমাদের চিটাগং পোর্টে যে হাইড্রোগ্রাফি রিকুইপমেন্ট হয়, সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাবে বলে আশা করছি।

জাগো নিউজ: আপনার বিভাগের গবেষণাগুলো কি দেশের নীতিনির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখছে?

অহিদুল আলম: অবশ্যই। ২০২১ থেকে ২০৩০ পর্যন্ত যে ওশান ডিকেইড (সমুদ্র দশক) চলছে, এটাতে আমার ডিপার্টমেন্টের ভূমিকা রয়েছে। আমরা সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ব্লু ইকোনমিক নিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি আমাদের সমুদ্রে কী পরিমাণ সম্পদ আছে, সেটা ফাইন্ড আউট করার জন্য কিছু প্রজেক্ট সাবমিট করেছি। টোটাল রিসোর্স কী পরিমাণ থাকতে পারে বিভিন্ন প্রাইমারি ডাটা থেকে বের করে পলিসি মেকারদের জানাবো কীভাবে আমরা এগুলো উত্তোলন করতে পারি ।

জাগো নিউজ: এই বিভাগের গ্র্যাজুয়েটরা সাধারণত কোন কোন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন?

অহিদুল আলম: আমাদের এই বিভাগ যাত্রা শুরু করে ২০১৮ সালে, যা স্বতন্ত্রভাবে চলছে। আমাদের যেসব ছাত্রছাত্রী গ্র্যাজুয়েট করে বের হয়েছে, তারা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠানে আছে। বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফি রিচার্জ ইনস্টিটিউশনে জব করছে। অনেক শিক্ষার্থী দেশের বাইরে ইউরোপ-আমেরিকায় পড়ালেখা করতে যাচ্ছে। অনেকে পড়ালেখা করার পর বিভিন্ন দেশে ওশান রিলেটেড বিভিন্ন গবেষণার সঙ্গে জড়িত রয়েছে।

জাগো নিউজ: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার জন্য আপনার বিভাগের প্রধান উদ্বেগগুলো কী কী?

অহিদুল আলম: আমরা এরইমধ্যে বিভিন্ন কোস্টাল কমিউনিটির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র যে গরম হচ্ছে, এটার জন্য ন্যাচারাল স্টোম এবং ন্যাচারাল সাইক্লোনের প্রভাব ভবিষ্যতে কীভাবে মোকাবিলা করতে পারি, সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি ওশান লিটারেসি, সমুদ্র শিক্ষার ভালো দিক খারাপ দিক বিষয়গুলো নিয়েও আমরা কোস্টাল কমিটির সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের শিক্ষকরা বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্টরের মাধ্যমে কোস্টাল কমিটির সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা যায়, এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আমাদের একদল গবেষক খুলনায় অবস্থান করছেন।

আরও পড়ুন:

জাগো নিউজ: সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গোপসাগরে যেসব ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে, সেগুলোর ওপর আপনারা কী গবেষণা করছেন?

অহিদুল আলম: আমরা ঘূর্ণিঝড়গুলোর প্রভাব বিষয়ে গবেষণা করছি। আমাদের স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড সিস্টেম চালু হলে আরলি ওয়ার্নিং সিস্টেম কোস্টাল ফার্মারদেরকে (উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষক) সুনির্দিষ্টভাবে আরও সতর্ক করতে পারবে। এতে ক্ষয়ক্ষতি কমবে।

জাগো নিউজ: সমুদ্রের প্লাস্টিক দূষণ রোধে বিভাগ কোনো গবেষণা বা উদ্যোগ নিয়েছে কি?

অহিদুল আলম: শুধু প্লাস্টিকই নয়; প্লাস্টিক পলিউশনের পাশাপাশি সমুদ্রে আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করছে মাইক্রো পলিউশন। মাইক্রোবিয়াল পলিউশন এসব নিয়েও কাজ করছি। আমাদের একদল গবেষক কর্ণফুলী নদীর মাইক্রোবিয়াল পলিউশন নিয়ে কাজ করেছেন। নদী বা সমুদ্রের ৮০ শতাংশ দূষণ আসে লাইন বেস থেকে। বিভিন্ন পলিথিনগুলো নালা-নর্দমা দিয়ে সমুদ্রে যাচ্ছে। মাইক্রোবিয়াল পলিউশন (পানি, মাটি বা বাতাসে অণুজীবের অবাঞ্ছিত উপস্থিতি, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে) যদি বাড়তে থাকে, তাহলে আগামী ৫০ বছর পরে মানুষ কক্সবাজার বা নদীতেও নামতে পারবে না। কারণ তারা বিভিন্ন ডিজিজে আক্রান্ত হবেন। এ নিয়ে আমরা সম্প্রতি একটা গবেষণাকার্য সম্পাদন করেছি।

পলিউশন বাড়তে থাকলে ৫০ বছর পরে মানুষ নদীতেও নামতে পারবে না

জাগো নিউজ: বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ কোনো প্রকল্প চালু আছে কি?

অহিদুল আলম: আমাদের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রাউন্ড স্টেশন এরকম একটি পরিকল্পনারই অংশ, যা চায়নার সেকেন্ড ইনস্টিটিউট ওশানোগ্রাফি আমাদেরকে ফান্ডিং করছে। পাশাপাশি অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের পরিকল্পনা আছে। ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করছি কীভাবে আমরা স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ করতে পারি ।

জাগো নিউজ: শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানোর জন্য কী ধরনের ল্যাব বা মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম রয়েছে?

অহিদুল আলম: আমাদের নতুন ফ্যাকাল্টি হওয়ায় ক্লাসরুমগুলো অনেক স্মার্ট। আমাদের ল্যাব ও ইন্সট্রুমেন্টের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কাজ করতে গেলে যে ধরনের ফান্ড দরকার আমরা এখনো সেই ধরনের ফান্ড পাইনি। আমাদের ছাত্রদের সমুদ্রে যাওয়ার জন্য কিছু উপকরণ গাড়ি দরকার, যাতে তারা সবসময় ফিল্ডে যেতে পারে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও আমরা কাজ করছি।

জাগো নিউজ: বর্তমানে আপনার বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী বলে আপনি মনে করেন?

অহিদুল আলম: আমাদের বিভাগের সেশনজটের সমস্যা ছিল, যেটা ওভারকাম করেছি। বর্তমানে পর্যাপ্ত ফান্ডিং দরকার, যাতে ল্যাবগুলোকে উন্নত করতে পারি। শিক্ষার্থীদের আরও কীভাবে গবেষণায় নিযুক্ত রাখতে পারি, সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। অধিক সময় ধরে যাতে তারা ল্যাবে থাকতে পারে, সে ধরনের ফ্যাসিলিটি আমাদের দাঁড় করানো দরকার। কিন্তু এই জায়গাটা আমরা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি।

জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে দেশে সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণায় কোন দিকে এগিয়ে যাবে বলে আপনি আশা করেন?

অহিদুল আলম: পৃথিবীর মোট আয়তনের ৭০ শতাংশের বেশি আমাদের সমুদ্র। আমি আশা করছি, ভবিষ্যতে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী সমুদ্রের সম্পদ এবং সমুদ্র ব্যবস্থাপনার গবেষণায় নিজেদেরকে অন্তর্ভুক্ত রাখতে পারবে। পাশাপাশি যাতে তারা উক্ত সম্পদ ন্যাশনাল ইকোনোমিতে, ব্লু ইকোনমিককে সম্পৃক্ত করতে পারে, এসব বিষয়ে তারা কাজ করবে।

জাগো নিউজ: এই বিভাগকে আগামী ১০ বছরে কোথায় দেখতে চান?

অহিদুল আলম: আমাদের এই ফ্যাকাল্টির এই বিভাগ থেকে সিংহভাগ গবেষণা কার্যক্রম চালু রয়েছে। আমি চাই আগামী ১০ বছরে আমাদের এই বিভাগ দেশের সেরা একটা ইনস্টিটিউট হোক। আমরা যদি পর্যাপ্তভাবে আমাদের ল্যাবগুলো উন্নত করতে পারি এবং শিক্ষার্থীরা যদি প্রোপারলি ল্যাবে কাজ করতে পারে, তাহলে ভালো করবে ইনশাআল্লাহ।

জাগো নিউজ: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

অহিদুল আলম: আপনাকেও ধন্যবাদ।

এসআর/এমএস