প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে চলছে কুড়িগ্রামের প্রাথমিক স্কুলগুলো
ভেঙে পড়েছে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদান প্রক্রিয়া। কক্ষ স্বল্পতা, শিক্ষক ও বই সঙ্কট, দীর্ঘমেয়াদী বন্যা এবং শিক্ষক অনুপস্থিতির কারণে জোড়াতালি দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা রুমে বসে বদলী বাণিজ্যে এসব স্কুলগুলোকে ব্যবহার করলেও তাদের তদারকিও শূন্যের কোঠায়। ফলে প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে চলছে বিদ্যালয়ের পাঠদান।
তবে এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ শিক্ষা কর্মকর্তারা। দায় এড়ানোর ফলে খবরের পাতায় মাঝেমধ্যে শিরোনাম হলেও কপাল খুলছে না পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীর।
সরেজমিনে সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ব্রহ্মপূত্র নদের বুক চিরে গড়ে ওঠা ঝুনকার চরে প্রতিষ্ঠিত মাঝিয়ালির চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল করুণ অবস্থা। জেলা সদর থেকে পশ্চিমে ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত স্কুলটি। ১৪ কিলোমিটার পাকা সড়ক। এরপর যাত্রাপুর নৌঘাট থেকে ব্রহ্মপূত্র নদে পঁচিশ মিনিট নৌকায় যাত্রা। ঝুনকারচর ঘাট থেকে পাশেই গড়ে উঠেছে স্কুলটি। স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর অভাব নেই। কিন্তু ক্লাস সঙ্কট আর শিক্ষক স্বল্পতার কারণে চরের শিশুগুলো অকালেই ঝড়ে পড়ছে।
দুপুর ১১টায় যখন এই প্রতিবেদক স্কুলে পৌঁছালো, তখন শিশু শ্রেণি থেকে ২য় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ছুটি দেয়া হল। ওরা হৈ হৈ করে চলে যেতেই অপেক্ষমান ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণির শিশুরা ক্লাসে প্রবেশ করল। স্কুলে তখনও নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকরা অনুপস্থিত। স্কুল পরিচালনা করছে ৩ প্রক্সি শিক্ষক। এরা হলেন বদিউজ্জামান, শাহজাহান ও ফারুক হোসেন। তিনজনই এসএসসি পাশ। একাধিক স্কুলে প্রক্সি দেয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন তারা। ফলে এই সমাজেও তাদের গ্রহণ যোগ্যতা রয়েছে।
এদের মধ্যে এক সময় ন্যাশনাল সার্ভিসের প্রথম ব্যাচে শিক্ষা বিভাগে কর্মরত বদিউজ্জামান জানালেন, বিগত ২০১৩ সাল থেকে তারা এই স্কুলে প্রক্সি শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। এজন্য তাদেরকে মাসে ৩ হাজার টাকা করে সম্মানী দেয়া হয়। যোগাযোগ সমস্যার কারণে শিক্ষকগণ নিয়মিতভাবে স্কুলে আসতে না পারার কারণে স্থানীয়রা স্কুলটি চালু রাখার জন্য সমঝোতার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নেন।
স্কুলে গিয়ে জানা গেল, প্রধান শিক্ষকসহ বাকি সহকারী শিক্ষকরাও অনুপস্থিত। তারা স্কুলে আসেন না। মাস শেষে একদিন সবাই মিলে নৌকা ভ্রমণ করে স্কুলে এসে স্বাক্ষর করে চলে যান। তাদের অনুপস্থিতিতে প্রক্সি শিক্ষক হিসেবে স্কুল চালাচ্ছেন এই চরের তিন যুবক।
শুধু এই স্কুলই নয়, সদর উপজেলার চরগুলোতে অবস্থিত ২০টি স্কুলের অধিকাংশই চলছে এই পদ্ধতিতে। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা বিভাগের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অবৈধভাবে মাসিক মাসোহারার মাধ্যমে এই পদ্ধতি চালু রেখেছেন। বছরের পর বছর স্কুলে না গিয়েও শিক্ষকরা প্রতিমাসে ঠিকই বেতন তুলে স্বস্তির ঢেকুর তুলছেন।
স্কুল কমিটির সভাপতি আমজাদ হোসেন জানান, এই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এরশাদুল হক বিগত ২০১৩ সাল থেকে এই স্কুলে আছেন। তিনি এখন ফার্মেসির ব্যবসা করেন। সহকারী শিক্ষক সাহানা আক্তার গত ৩ বছর থেকে ডেপুটিশনে সদরের বীর প্রতীক তারামন বিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছেন। অপর সহকারী শিক্ষক শিরিনা আক্তার শিউলী ২০১৪ সাল থেকে এবং শামসুন নাহার ২০১৫ সাল থেকে এই স্কুলে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এরা সবাই সদর উপজেলার বাসিন্দা। এরা নিয়মিতভাবে স্কুলে না আসায় চরের শিশুদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে স্কুলটি পরিচালনা করা হচ্ছে। 
তিনি আরও দাবি করেন শুধু এই স্কুলই নয় বরং চরের প্রতিটি স্কুলে ২/১জন শিক্ষক ছাড়া প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে স্কুল পরিচালনা করা হচ্ছে।
এই স্কুলের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী উম্মে ছালমা, রাসেল মফিজুল, আব্দুল হামিদ ও আব্দুল হাই জানায়, শিক্ষকরা প্রতিদিন ক্লাস নিলে তারা আরো ভাল ফলাফল করতে পারতো। এছাড়াও তারা অভিযোগ করে ৪ মাস পার হলেও এখনো তারা ৪টি করে বই পায়নি। ফলে ১ম সাময়িক পরীক্ষা তাদের ভাল হয়নি।
এ ব্যাপারে প্রক্সি শিক্ষক ফারুক হোসেন জানান, ৫ম শ্রেণির ১৫ জন শিক্ষার্থী এখনো বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক ও ধর্ম বই পায়নি। বই সঙ্কটের কারণে তাদেরকে ৪ সেট বই দেয়া সম্ভব হয়নি।
মুঠোফোনে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এরশাদুল হক জানান, ব্যস্ততার কারণে আজ তিনি স্কুলে যেতে পারেননি। এরপর তিনি বলেন, ভাই লেখালেখি করলে অফিসারদের লাভ। আমার মতো চরের সব স্কুলেই একই ব্যবস্থা। টাকা দিলে সবাই ম্যানেজ হয়। মাঝখান থেকে আমাদের ভোগান্তি। বাড়তি টাকা খরচ।
তবে এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান।
তিনি দাবি করেন, বই না পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। শিক্ষক প্রক্সির বিষয়টিও তিনি এড়িয়ে যান।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, ১৬টি নদ-নদী দিয়ে ঘেরা কুড়িগ্রামে সাড়ে ৪শ চরের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ শ চরে জনবসতি রয়েছে। জেলার ১ হাজার ২১৭টি স্কুলের মধ্যে চরে রয়েছে ২০৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ২০টি, উলিপুরে ৪০টি, চিলমারীতে ২৭টি, নাগেশ্বরীতে ৫৪টি, ফুলবাড়তে ১৭টি, ভুরুঙ্গামারীতে ১০টি, রাজারহাটে ৭টি, রৌমারীতে ১২টি এবং রাজিবপুরে ১৯টি। মোট শিক্ষার্থীর ৮৩ হাজার ৩শ’ জনের মধ্যে চরে রয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী।
এফএ/এমএস
সর্বশেষ - দেশজুড়ে
- ১ স্বাস্থ্যের ডিজির সঙ্গে তর্কে জড়ানো চিকিৎসককে অব্যাহতি ও শোকজ
- ২ মৃতের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সড়কে লাশ হলেন শাশুড়ি-পুত্রবধূ
- ৩ গাজীপুরে ভাড়া ফ্ল্যাটের দরোজা ভেঙে প্রধান শিক্ষিকার মরদেহ উদ্ধার
- ৪ নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন, ইউনূসের হাত রক্তে রঞ্জিত
- ৫ ঠাকুরগাঁওয়ে সারের ডিলারশিপ বাঁচাতে পদ ছাড়লেন ইউপি চেয়ারম্যান