ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

পূর্বাচলের নীলা মার্কেট

সন্ধ্যা হলেই যেখানে বাতাসে ভাসে হাঁস ভুনার সুবাস

নাজমুল হুদা | রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) | প্রকাশিত: ১০:৪৮ এএম, ২৩ জুলাই ২০২৫

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচলের নীলা মার্কেটকে কেন্দ্র করে বালু নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে বিশাল এক খাবারের হাট। ব্যতিক্রমধর্মী এই ফুড জোনকে স্থানীয়রা বলছেন রসনার হাট। পুরো এলাকা যেন এক ভোজন জগৎ। আলোর ঝলকানি, ধোঁয়ার ঘ্রাণ, আর স্বাদের আমন্ত্রণে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মুখর থাকে চারপাশ। বালু নদীর তীর ও লেকের পাড়ে খোলা আকাশের নিচে গড়ে ওঠা এ খাবারের রাজ্যে প্রতিদিন জমে ওঠে ভোজন রসিকদের মিলনমেলা।

প্রায় দুই শতাধিক বাহারি খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁগুলোতে শুক্র-শনিবারসহ যেকোনো বন্ধের দিনে ভোজন রসিকদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। এখানে সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় রসনা, স্বাদের মহোৎসব।

ঢাকার সন্নিকটে পূর্বাচল উপশহরের বুক চিরে ছুটে চলা ৩০০ ফিট এক্সপ্রেসওয়ে মানুষের কাছে খুবই আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় একটি স্থান। নান্দনিক সেই মহাসড়কের পাশেই বালু নদীর পূর্ব তীরে এই নীলা মার্কেট। পূর্বাচল উপশহরের সেক্টর-১ এ বিশাল জায়গাজুড়ে এই মার্কেট। এছাড়াও ১১ ও ১২ নম্বর সেক্টর এবং ময়েজউদ্দিন চত্বরেও অসংখ্য খাবারের দোকান পসরা সাজিয়ে বসে।

সন্ধ্যা হলেই যেখানে বাতাসে ভাসে হাঁস ভুনার সুবাস

নীলা মার্কেটকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত এই খাবারের রাজ্যে রয়েছে প্রায় ২০০টিরও বেশি রেস্টুরেন্ট ও খাবারের স্টল, যা প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মুখর থাকে ভোজন রসিকদের পদচারণায়। এসব রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে পূর্বাচলের বিভিন্ন সেক্টরের লেকের পাড়ে ও খোলা আকাশের নিচে বালু নদীর পাড় ঘেঁষা মনোরম পরিবেশে। একদিকে লেকের বাতাস, অন্যদিকে নদীর ঢেউয়ের কলকল শব্দ। মনোরম এক পরিবেশে জমে ওঠে রসনার উৎসব।

নদীর তীর আর লেকপাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা জমজমাট এ ফুড জোনে দূরদূরান্ত থেকে হাঁসের মাংস খেতে আসেন অনেকে। বসে উপভোগ করেন দেশি হাঁসের ঝাল ঝাল মাংস কষা, সঙ্গে বাহারি পিঠা। এসব খাবারের দোকান এবং রেস্টুরেন্টগুলোতে কৃত্রিম ফুল ও রঙিন বাতির ঝলকানি দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনা জানায়। প্রতিটি দোকানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষ করে হাঁসের মাংসের বিশেষ রেসিপি আর গরম রুমালি রুটির সমন্বয়ে তৈরি খাবার এখন নীলা মার্কেটের এক স্বাদ-আইকন হয়ে উঠেছে।

সন্ধ্যা হলেই যেখানে বাতাসে ভাসে হাঁস ভুনার সুবাস

সকাল থেকেই শুরু হয় রসনার আয়োজনে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। দুপুরের পর পরই শেষ হয়ে যায় মাংস কাটা ধোয়া। সূর্য পশ্চিমে ঢলতেই বড় বড় কড়াইয়ে শুরু হয় রান্না। আর তাতেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে ঘ্রাণ। নীলা মার্কেট ভোজন রসিকদের জন্য দারুণ একটি জায়গা। এখানে যেমন আছে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ ও ক্যাফে। তেমনি আছে সাদাসিধে অনেক খাবারের দোকান। এসব দোকানে মূলত বিক্রি হয় হাঁসের মাংস ও চালের রুটি। এছাড়া আছে নানা ধরনের বাহারি পিঠা। প্রতিদিন গরম গরম হাঁসের মাংস, রুমালি রুটি, আতপ চালের চাপটি পিঠা, চিতই পিঠা আর সামুদ্রিক মাছের বারবিকিউ নিয়ে পসরা সাজায় কয়েকশ দোকানি। এখানে রয়েছে বাহারি চা, ফলমূল ও মিষ্টির দোকানও।

দেশি পাতি হাঁসের মাংস ভুনা ছাড়াও গরুর মাংস, দেশি মুরগি ভুনা, গরুর বটও পাওয়া যায় প্রায় দোকানেই। আরও পাওয়া যায় হরেক রকমের ভর্তা। হাঁসের মাংস ৩০০ টাকা প্লেট, যাতে ১টি লেগ পিসসহ মোট ৫ পিস মাংস থাকে, সঙ্গে আনলিমিটেড ঝোল। এছাড়া গরুর মাংস ২৫০, দেশি মুরগি ৩০০, আর গরুর বট ২০০ টাকা প্লেট। মাংসের সঙ্গে খাওয়ার জন্য চাপটি, আটার রুটি, রুমালি রুটি ২০ টাকা করে, আর ডিম চাপটির দাম ৪০ টাকা। প্রচলিত গ্রামীণ পিঠাকে এখানে নতুন রূপে পরিবেশন করা হয়।

আরও চমক রয়েছে সামুদ্রিক মাছের বারবিকিউতে। রূপগঞ্জে বসেই যেন মানুষ সাগর উপকূলের আমেজ উপভোগ করছেন। নিচ্ছেন সমুদ্রের বাহারি মাছের স্বাদ। তাজা চিংড়ি, কাঁকড়া, স্যামন, কোরাল ও লবস্টারের বারবিকিউ সরাসরি চোখের সামনে গ্রিল হয়ে পরিবেশিত হয়।

সন্ধ্যা হলেই যেখানে বাতাসে ভাসে হাঁস ভুনার সুবাস

বাহারি সব মিষ্টির দোকানে রয়েছে রসগোল্লা, বালিশ মিষ্টি, মালাই চপ, সন্দেশ, ল্যাংচা, গোলাপ জামুন, ছানা, দধি থেকে শুরু করে প্রায় সবধরনের জনপ্রিয় মিষ্টি। এছাড়াও রয়েছে ৫০ ও ৬০ টাকা মূল্যে দুই ধরনের তন্দুরি চা।

এই রসনার বাজারকে কেন্দ্র করে পর্যটক আকর্ষণে স্থায়ী আনন্দমেলারও আয়োজন রয়েছে। এ কারণেও এলাকাটি অনেকের প্রিয়। এখানকার বছর জুড়ে চলা আনন্দ মেলা দর্শনার্থী টানতে বেশ ভূমিকা রাখছে। যেখানে রয়েছে মেলা কেন্দ্রিক বাহারি সব জিনিসপত্র। রয়েছে শিশুদের আনন্দ বিনোদনের বিভিন্ন রাইডস। নাগরদোলা, নৌকা ছাড়াও থাকে শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা। অন্য যেকোনো মেলার মতোই হরেক আইটেমের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। সব মিলিয়ে ভোজন রসিক ও বিনোদন প্রেমীদের মিলন মেলার একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে পূর্বাচলের নীলা মার্কেট।

রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকেও মানুষ ছুটে আসে এই হাঁসের ভুনা, রুটি-পিঠার স্বর্গে। জমে ওঠা এই ফুড হাট এখন রূপগঞ্জবাসীর সন্ধ্যার প্রধান আকর্ষণ। এটি স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ব্যবসা, কর্মসংস্থান, আর খাদ্যসংস্কৃতির এক চমৎকার মেলবন্ধন এখন নীলা মার্কেট।

সন্ধ্যা হলেই যেখানে বাতাসে ভাসে হাঁস ভুনার সুবাস

এই ফুড জোন হয়ে উঠেছে এক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। সৃষ্টি হয়েছে কয়েকশ মানুষের কর্মসংস্থান। পর্যটন, খাদ্যসংস্কৃতি আর উদ্যোক্তা চেতনার মেলবন্ধনে রূপগঞ্জের এই নদী ও লেক পাড়ের খাবার বাজার এখন শুধু একটি স্থান নয়, এটি একটি অনুভব।

ঢাকার মালিবাগ থেকে হাঁসের মাংস আর চাপটি পিঠা খেতে এসেছেন ওয়াহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, সময় পেলে প্রায়ই নীলা মার্কেটে আসি। ঢাকার খুবই সন্নিকটে পূর্বাচলে ব্যতিক্রমধর্মী এক ভোজন জগৎ। এ রসনার হাটে হাঁসের মাংসের স্বাদ, নদীর পাড়ে কাঠ বাঁশের খোলামেলা ঘরে আলোর ঝলকানি, লেকের বাতাস আর নদীর ঢেউয়ের কলকল শব্দের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে বসে পছন্দের খাবার খাওয়া। সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। খুবই ভালো লাগে।

ডেমরা থেকে পরিবার নিয়ে এসেছেন সগীর আহমেদ। তিনি জানান, নীলা মার্কেটের আশপাশে যেমন রয়েছে বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট, তেমনি রয়েছে সাধারণ লোকের জন্য সাদামাটা খাবার ঘর। কিন্তু স্বাদে ভরপুর দোকানগুলোর সব খাবার। প্রতিটি দোকানেই খাবার তৈরি হয় সরাসরি দর্শনার্থীদের চোখের সামনে, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের গ্রিল করে পরিবেশন করা হয়। তার ওপর বারোমাসী মেলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকায় আমার বাচ্চারা এখানে এসে খুবই খুশি।

সন্ধ্যা হলেই যেখানে বাতাসে ভাসে হাঁস ভুনার সুবাস

‘বিথির মা’ পিঠা ঘরের মালিক আলমগীর হোসেন বলেন, প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি রান্না আর পরিবেশনে ব্যস্ত থাকতে হয়। শুক্রবার দোকানের সামনে লাইন লেগে যায়। পূর্বাচলের সেক্টর ১, ১১ ও ১২ সহ ময়েজ উদ্দিন চত্বরের আশেপাশে অসংখ্য খাবারের দোকান রয়েছে। পূর্বাচলে সব মিলিয়ে প্রায় ২০০’র উপরে খাবার দোকান রয়েছে। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভোজন রসিকদের আনাগোনা থাকে এবং আমাদের বেচা-বিক্রি চলে। এখানকার খাবার শুধু স্বাদেই সীমাবদ্ধ নয়, পরিবেশও দারুণ মনোমুগ্ধকর। নদীর বাতাস ও লেক পাড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন আগত দর্শনার্থীরা।

কুটির বাড়ি রেস্টুরেন্ট ও পিঠা ঘরের মালিক দোলা আক্তার বলেন, দেশি পাতিহাঁস জবাই করে গোস্ত এবং চাপটি পিঠার জন্য চাউলের গুঁড়াসহ সবকিছু রেডি করে দুপুর হয়ে যায়। আর তখন থেকেই শুরু হয় বেচাকেনা। চলে গভীর রাত পর্যন্ত দেশি পাতি হাঁসের মাংসের ভুনা ছাড়াও গরুর মাংস, দেশি মুরগি ভুনা, গরুর বটও পাওয়া যায় আমাদের দোকানে। সেইসঙ্গে আরও পাওয়া যায় হরেক রকমের ভর্তা। পূর্বাঞ্চলের এ ফুড জোনে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার খাবার বিক্রি হয়। এখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করে আমরা খুবই ভালো আছি।

কথা হয় পূর্বাচলের পার্শ্ববর্তী বাঘবের এলাকার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট ইসরাফিল হোসাইনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাড়ির খুব কাছেই এই ফুড জোন। সময় পেলেই এখানে খেতে চলে আসি। শুধু খাবারেই সীমাবদ্ধ নয় এ অঞ্চল, এলাকাবাসীর জীবিকা আর পর্যটনের মিলনস্থল। পূর্বাচলের নীলা মার্কেট এখন শুধু একটি খাবারের বাজার নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক মিলনমঞ্চ। যেখানে স্বাদ, সৌন্দর্য, সংস্কৃতি আর অর্থনীতি এক সুতোয় গাঁথা।

এফএ/জেআইএম