তেঁতুলিয়ার মেঘমুক্ত আকাশে উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা
কাঞ্চনজঙ্ঘা আর হিমালয় পর্বতমালার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে পর্যটকদের ভিড় এখন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। সর্বোত্তরের এই সীমান্ত উপজেলার মহানন্দার পাড়সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দেখা যাচ্ছে সোনালি কাঞ্চনজঙ্ঘা। বর্ষা শেষে এবং শীত মৌসুমের শুরুতে আকাশে তেমন মেঘ আর কুয়াশা না থাকায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই পর্বতশৃঙ্গ। কোনো রকম কৃত্রিম যন্ত্র ব্যবহার না করেও দূর পাহাড়ের চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে বিমোহিত দেশীয় পর্যটকরা।
শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরের মহানন্দার পাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, সীমান্ত উপজেলাটি এখন পর্যটকদের পদচারণায় মুখর। ভোর থেকে যখন আকাশ মেঘমুক্ত থাকে, তখন দৃষ্টিনন্দন কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে নেয় প্রকৃতিপ্রেমীদের। নীল আকাশে বরফে ঢাকা সাদা পাহাড় মুহূর্তেই যেন দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করছে। মহানন্দা পাড়ের ডাকবাংলো এলাকায় দুপুর পর্যন্ত দেশীয় পর্যটকদের ভিড় দেখা গেছে। জেলার আশপাশ এলাকার পর্যটক ছাড়াও ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসছেন পর্যটকরা। বিশেষ করে শীত মৌসুম ঘনিয়ে আসার আগে ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় বাড়ছে।
ভোরে সূর্যের আলো পড়তেই বরফাচ্ছন্ন পাহাড়গুলো রূপ নেয় সোনালি আভায়। পর্যায়ক্রমে লাল, কমলা আর সোনালি আভায় সেজে ওঠা দৃশ্য দেখে মুগ্ধ দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকরা। তেঁতুলিয়াকে কেন্দ্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন ছাড়াও চা-বাগান, চা কারখানা, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, বাংলাবান্দা জিরোপয়েন্ট থেকে খোলা মাঠে পর্যটকরা কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য উপভোগ করছেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পঞ্চগড়ের সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা থেকে ভারতের শিলিগুড়ির দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে দার্জিলিং শহর। এখান থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার, ভূটানের দূরত্ব ৬৪ কিলোমিটার, চীনের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার।
তেঁতুলিয়ায় রাত কাটালেই দেখা যাবে আলোকিত দার্জিলিং শহর। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার। কাঞ্চনজঙ্ঘা মূলত নেপাল এবং সিকিমের সীমান্তে অবস্থিত। উচ্চতার দিক থেকে পৃথিবীর প্রথম সারির যে তিনটি পর্বত হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত, সেই পর্বতমালায় প্রথম অবস্থানে রয়েছে মাউন্ট এভারেস্ট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার বা ২৯ হাজার ২৯ ফুট। আর পর্বত কেটু’র উচ্চতা ৮ হাজার ৬১১ মিটার বা ২৮ হাজার ২৫১ ফুট এবং তৃতীয় উচ্চতায় থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার বা ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট। হিমালয় পর্বতের এই অংশটিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালয় বলা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন-
পাহাড়ের বুক চিরে ঝরে পড়ে চিংড়ি ঝরনা
যেখানে দাঁড়ালে দেখা যায় দুই দেশের পাহাড়
পূজার ছুটিতে রেকর্ড পর্যটক বরণে প্রস্তুত কুয়াকাটা
কাঞ্চনজঙ্ঘার সুউচ্চ এই চূড়া দেখতে অনেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা শহরের টাইগার হিলে যান। দার্জিলিংয়ের টাইগার হিল এই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখার আদর্শ স্থান। তবে কেউ কেউ সান্দাকপু বা ফালুটেও যান। কেউ আবার সরাসরি নেপালে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিন্তু পাসপোর্ট আর ভিসার মাধ্যমে যেতে না পারা ভ্রমণপিপাসুরা প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসছেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়।

শুক্রবার দুপুর গড়ালে তেঁতুলিয়ার মহানন্দার পাড়ে দেখা হয় রংপুরের তারাগঞ্জ এলাকা থেকে আসা আব্দুর রহিমের সঙ্গে। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তেঁতুলিয়ায় এসেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে। সেখানে তারা রাত্রীযাপন করেন। ভোরের আকাশে সোনালি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে মুগ্ধ তারা।
আব্দুর রহিম বলেন, এর আগে ফেসবুক, টেলিভিশন, পত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখেছি তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। খোঁজখবর নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ এসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলাম। বেশ ভালো লাগলো। এখান থেকে রাতে পাহাড়ের বাতিও দেখা যায়। এটা একটা অন্যরকম অনুভূতি।
স্থানীয় ইজিবাইক চালক শাহাজান আলী বলেন, প্রতি বছর এই সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ তেঁতুলিয়ায় আসেন। অনেকে পরিবার নিয়ে আসেন। তারা তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সকাল এবং বিকেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখেন। এখানে, চা বাগান, কমলা বাগান, পুরাতন ডাকবাংলো, আনন্দধারা, মহানন্দা নদী, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট রয়েছে। আমরা এসব জায়গা তাদের তাদের ঘুরে দেখাই।
সাধারণত অক্টোবরের শুরু থেকে নভেম্বর জুড়ে পঞ্চগড়ের আকাশ কিছুটা মেঘহীন থাকে। বর্ষার শেষ সময়ে আকাশ বাতাসে ধুলিকণাও তেমন নেই। এসময় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে উত্তর-পশ্চিম আকাশে তাকালে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। উত্তরের মেঘহীন আকাশে ভেসে ওঠে হিমালয় পর্বতমালা। প্রতিবছরের মতো এবারো মেঘহীন আকাশে উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার নয়নাভিরাম রূপ।
পঞ্চগড় টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের প্রভাষক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সপরিবারে দার্জিলিং গিয়ে সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি। তবে তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সৌন্দর্যই আলাদা। এটা পৃথিবীর আর অন্য কোথাও থেকে এমন করে দেখা যাবে বলে মনে হয় না। পাহাড়ের সৌন্দর্য আসলে দূর থেকেই দেখা যায়। পাহাড়ের বিশালতা দেখতে হলে সমতল থেকেই দেখতে হবে। পাহাড়ে উঠে তার বিশালতা অনুভব করা যায় না।

তেঁতুলিয়া ট্যুরিস্ট পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক রাব্বুল ইসলাম বলেন, শীত মৌসুমে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। আমরা পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করছি। এখানকার মানুষ এমনিতেই শান্ত প্রকৃতির। এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো। প্রতি বছরের মতো এবারও বিভিন্ন এলাকার মানুষ কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখতে আসছেন।
জেলা প্রশাসক সাবেত আলী বলেন, সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়া একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। এখানে বছরজুড়ে প্রকৃতিপ্রেমী আর পর্যটকরা ছুটে আসেন। তবে বর্তমান সময়ে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব কাছেই এই পর্বতশৃঙ্গ। এই সময়ে সাধারণত আকাশ মেঘমুক্ত থাকে। সকাল এবং বিকেলের আকাশে তাকালে ভেসে ওঠে সোনালি কাঞ্চনজঙ্ঘার নয়নাভিরাম রূপ। কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই রূপ কাছ থেকে দেখতে এখানে অসংখ্য মানুষ আসছেন। অনেকেই পরিবার নিয়ে তেঁতুলিয়ায় রাত্রীযাপন করছেন। বর্তমানে তেঁতুলিয়ায় আবাসন সুবিধা বেশ ভালো।
তিনি বলেন, তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নারে আগের দুইটি ডাকবাংলোতে স্থান সংকুলান হয় না। পরে সেখানে ‘বেরং কমপ্লেক্স’ নামে আরেকটি ডাকবাংলো গড়ে তোলা হয়েছে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। আর পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ নিরলস কাজ করছে। সব মিলিয়ে এই সময়ে দেশীয় পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমীরা তেঁতুলিয়া ঘুরে গেলে মানসিক তৃপ্তি নিয়েই ঘুরে যেতে পারবেন বলে আশা করি।
এফএ/এমএস