ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

বগুড়া-৪

বিএনপির দুর্গে ফ্যাক্টর আওয়ামী লীগের ‌‘ভোটব্যাংক’

নিজস্ব প্রতিবেদক | বগুড়া | প্রকাশিত: ০৩:৩৯ পিএম, ০৭ অক্টোবর ২০২৫

বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসন যেন এক অবিচল রাজনৈতিক দুর্গ। যেখানে স্বাধীনতার পর থেকে বহুবার পাল্টেছে সংসদ সদস্য, রূপ বদলেছে নির্বাচনী জোটের, কিন্তু এই আসনে বিএনপি-জামায়াতের আধিপত্যই রয়ে গেছে নিরঙ্কুশ। তবে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট।

কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা মাঠে নেই, কিন্তু তাদের ভোট ব্যাংককে ঘিরে হিসাব-নিকাশ চলছে জোরেশোরে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আসনটিতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার ভোট রয়েছে আওয়ামী লীগ ও মিত্র জোটের ঘরে। এই ভোট কার ঝুলিতে যাবে, এটাই এখন বগুড়া-৪ আসনের নির্বাচনী উত্তাপের মূল কেন্দ্রবিন্দু।

বগুড়া-৪ আসনে মোট ভোটার প্রায় তিন লাখ ২৫ হাজার। এরমধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ৬০ হাজার। ভোটারদের বড় অংশই কৃষির সঙ্গে জড়িত। জীবিকা ও জীবনধারায় এখনো গ্রামীণ চরিত্র প্রবল। ধর্মীয় আবেগও এ আসনের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বড় উপাদান। ভৌগোলিকভাবে আসনটি দুই রকম চরিত্র ধারণ করেছে। নন্দীগ্রামে রাজনৈতিক সচেতনতা ও কর্মতৎপরতা তুলনামূলক বেশি। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীরা মাঠপর্যায়ে সক্রিয়। অন্যদিকে কাহালুতে পরিবারভিত্তিক প্রভাব, ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর দলীয় আনুগত্য বেশি কার্যকর।

দুই উপজেলা মিলিয়ে রয়েছে ২০টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা। এসব অঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলো ঘিরেই মূলত প্রার্থীরা নির্বাচনী কৌশল সাজান। গ্রামভিত্তিক পদক্ষেপ, স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারের সমর্থন এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের দলীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভোটের অঙ্ক কষা হয়। তবে অনেক সময় প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণে বেশ ভূমিকা থাকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।

বিএনপির টানা আধিপত্য

স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে ১২টি সংসদ নির্বাচন। কিন্তু বগুড়া-৪ আসনে ভোটযুদ্ধ হয়েছে ১৪ বার। এরমধ্যে দুটি উপ-নির্বাচন।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের মোজাফর হোসেন প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও এরপর থেকে শুরু হয় জাতীয়তাবাদী ধারার প্রভাব বিস্তার। প্রায় তিন দশক ধরে বিএনপি-সমর্থিত নেতারা এই আসনে আধিপত্য ধরে রাখেন। একেএম মতিয়ার রহমান প্রামাণিক, আজিজুল হক মোল্লা ও তার ছেলে ডা. জিয়াউল হক মোল্লা এবং জেড আই এম মোস্তফা আলী ধারাবাহিকভাবে আসনটি নিজেদের দখলে রাখেন।

শুধু ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের সুযোগে আওয়ামী জোটের শরিক জাসদের প্রার্থী রেজাউল করিম তানসেন একবার আসনটি দখলে নেন। কিন্তু ২০১৮ সালের ভোটে মোশারফ হোসেনকে প্রার্থী করে আবারও আসন ফিরে পায় বিএনপি। সবমিলিয়ে এই আসনের নির্বাচনী ইতিহাস বলছে, বিএনপির শিকড় এখানে সবচেয়ে গভীর। অন্যদের উপস্থিতি বরাবরই ব্যতিক্রমধর্মী ও সীমিত।

পুরোনো মুখ বনাম নতুন চমক

বগুড়া-৪ আসনে বিএনপি শিবিরে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় আছেন তিনজন অভিজ্ঞ মুখ। সাবেক সংসদ সদস্য মোশারফ হোসেন দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘনিষ্ঠতার কারণে এগিয়ে আছেন আলোচনায়।

তিনি বলেন, ‘আমি বিগত সময়ে এই এলাকার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছি। দলীয় নেতা তারেক রহমান আমাকে পছন্দ করেন। নানা রকম জুলুম-হামলা-মামলা নিজেও সয়েছি আবার নেতাকর্মীদের সঙ্গেও থেকেছি। দিনরাত তাদের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি। এসব কারণে আমাকে মূল্যায়ন করা হবে বলে মনে করছি।’

অন্যদিকে ফজলে রাব্বি তোহা মূলত দলের ভেতরকার সাংগঠনিক কাজের জন্য পরিচিত। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ তাকে শক্ত অবস্থানে রেখেছে। তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে মানুষের আকাঙক্ষার প্রতিফলন হয়নি। এ কারণে তারা মুখের পরিবর্তন চান। মানুষের দাবি অনুসারে মাঠে নেমেছি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেখবো।’

আরেকজন প্রবীণ নেতা ডা. জিয়াউল হক মোল্লা তার ব্যক্তিগত ইমেজ, চিকিৎসক হিসেবে সেবা এবং অতীতের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। তিনজনই নিজেদের ত্যাগ-তিতিক্ষার রাজনীতি তুলে ধরে কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন চাইছেন। ফলে বিএনপির ভেতরে প্রার্থী চূড়ান্ত করা এখন জটিল বিষয় হয়ে উঠেছে। যদিও বিগত নির্বাচনে অংশ নিয়ে ডা. মোল্লা দলীয়ভাবে কালো তালিকাভুক্তির মধ্যে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে বরাবরই রয়েছি। এখনো থাকবো।’

আরও পড়ুন:
বিএনপির ঘাঁটি উদ্ধারে বাধা অনৈক্য, সুযোগ নিতে চায় জামায়াত
‘বিএনপির ঘাঁটি’তে ফ্যাক্টর মান্না-জামায়াতের শাহাদাতুজ্জামান
তালুকদার পরিবারের প্রতি টান প্রবীণদের, নতুনরা চান পরিবর্তন
বিএনপির ঘাঁটিতে জয়ের স্বপ্ন জামায়াতের
জামায়াতসহ ৫ দলে একজন করে প্রার্থী, বিএনপিতে ছড়াছড়ি
বিএনপির মনোনয়ন চান চার নেতা, একক প্রার্থীতে উজ্জীবিত জামায়াত
ডাকসু-জাকসু : জাতীয় নির্বাচনের মহড়া?

অন্যদিকে এবারের নির্বাচনে নতুন মুখ তুলে ধরতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী। তুরস্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ড. মোস্তফা ফয়সাল পারভেজকে ঘিরে সংগঠনের ভেতরে বেশ আলোচনার ঝড়। তরুণ শিক্ষিত ইমেজ, আন্তর্জাতিক শিক্ষাগত যোগ্যতা আর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাকে ঘিরে স্থানীয় জামায়াত কর্মীরা উচ্ছ্বসিত। বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রার্থী জামায়াতকে নতুন করে তরুণ ভোটারদের কাছে উপস্থাপন করতে পারেন।

ড. মোস্তফা ফয়সাল বলেন, ‘আমরা শুধু কথা বলে প্রতিশ্রুত দিই না, সেটি বাস্তবায়ন করে দেখাই। এখন মানুষের সঙ্গে আছি। ভোটে জেতা না জেতা ব্যাপার না, মানুষের সঙ্গে সবসময়ই থাকতে চাই।’

জাতীয় পার্টি, কংগ্রেস, গণতন্ত্রী দল এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র দল এখনো দৃশ্যমান শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হাজির না হলেও তাদের উপস্থিতিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষ করে আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের নাম উঠলেই স্থানীয় ভোটাররা উচ্ছ্বাস আর কৌতূহল মেশানো প্রতিক্রিয়া দেন। যদিও তাকে নিয়ে বড় দলগুলো হাস্যরস করে, তবু তার প্রার্থী হওয়া মানেই একটি নির্দিষ্ট অংশের ভোট কেটে নেওয়া নিশ্চিত। যদিও হিরো আলমের সঙ্গে নির্বাচনী ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। ফলে মাঠের প্রধান লড়াই যতটা বিএনপি-জামায়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ মনে হচ্ছে, ভোটের সমীকরণে এ ধরনের প্রার্থীরাও শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। মাঠে আরও রয়েছেন আইনজীবী গোলাম আকতার জাকির।

হামলা-মামলার ছায়া

বগুড়া-৪ আসনটি যতটা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই স্পর্শকাতর ও সংঘাতপ্রবণ। এই আসনের প্রতিটি নির্বাচনী মৌসুমেই উত্তেজনা যেন ছায়ার মতো লেগে থাকে।

অতীতের ভোটগুলোতে দেখা গেছে, সংঘর্ষ, ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্র দখল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে হামলা-মামলার দীর্ঘ অধ্যায়। নির্বাচনের আগে ও পরে মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার প্রবণতাও এখানে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই হামলা-মামলার ভয়াবহতা বাড়তে পারে।

বগুড়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ মনে করেন, বগুড়া-৪ আসনে নির্বাচনী সমীকরণ সবসময়ই ব্লক ভোটিংয়ের মতো। মানে, ভোটারদের বড় অংশ শেষ মুহূর্তে দল বা জোটের কৌশল দেখে হঠাৎ একদিকে ঝুঁকে পড়ে।

অধ্যাপক ইউসুফের মতে, আওয়ামী লীগ সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকলেও তাদের সমর্থকরা একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকবেন না। বরং মাঠের পরিস্থিতি বুঝে কারও পক্ষে চলে যেতে পারেন, আর সেখানেই মূল সমীকরণ বদলে যাবে। তাই বিএনপি-জামায়াত যেদিকে ভোটারদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বার্তা দিতে পারবে, তারাই ফল নির্ধারণে এগিয়ে থাকবেন।

অধ্যাপক ইউসুফ বলেন, তানসেন দুইবার নির্বাচিত হলেও স্থানীয়ভাবে তার গ্রহণযোগ্যতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যক্তিগতভাবে এলাকার মানুষ তাকে ঘনিষ্ঠভাবে পায়নি। অন্যদিকে জামায়াত তরুণ ও শিক্ষিত নতুন মুখ দিয়ে চমক দিতে চাইছে। বিএনপির ভেতরে ঐক্য ও নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিধা রয়ে গেছে। কে প্রার্থী হবেন, কাকে মাঠে সবাই মেনে নেবে—এ নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হয়নি।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, শেষ সময়ে জোট গঠন, সমঝোতা অথবা বিপরীতে যদি ভোট ভাগাভাগি হয়; দৃশ্যপট আমূল বদলে যেতে পারে। তাই এখনই কার পাল্লা ভারী বলা কঠিন।

এলবি/এসআর/এমএমএআর/এমএস