ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ প্রশাসন, পাহাড়ধসে বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

সায়ীদ আলমগীর | কক্সবাজার | প্রকাশিত: ১২:৫৩ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

চলছে শরৎকাল। সময়ে-অসময়ে বৈরি আবহওয়ায় ঝরছে বৃষ্টি। সাগর-উপকূলে সৃষ্টি হওয়া লঘু ও নিম্নচাপের প্রভাবে হালকা-মাঝারি-ভারী বর্ষণে তলিয়ে যায় শহর-গ্রামের নিম্নাঞ্চল। বাতাসের ঝাপটায় ওড়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঝুপড়ি ও ভাঙে গ্রামের অনেক কাঁচাবাড়ি। এছাড়া ভারী বর্ষণে বাড়ে পাহাড়ধসের শঙ্কা।

এভাবে গত এক দশকে (২০১৫-২০২৫) ২১টি পাহাড় ধসের ঘটনায় কক্সবাজার জেলায় মারা গেছে ৪৮ জন। এদের মাঝে ২৯ জন স্থানীয় আর ১৯ জন আশ্রিত রোহিঙ্গা। ২১টি পাহাড় ধসের ঘটনায় ১০টিই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের। এসব পাহাড় ধসে ২৫-৩০ জন আহতও হয়েছিলেন বলে প্রশাসনিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাসকারীদের সরানো যায় না। সারাবছর নীরব থেকে, বর্ষায় টানাবৃষ্টি হলেই হাঁকডাক শুরু করে প্রশাসন। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান ছাড়েন না অনেকেই। ফলে পাহাড় ধসে মারা যায় মানুষ। বনবিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর মামলাও করেছে অনেক। এরপরও এর সমাধান আসছে না বলে দাবি পরিবেশবাদীদের।

মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ প্রশাসন, পাহাড়ধসে বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

তাদের মতে, পাহাড় থেকে অবৈধ বাস সরানো না গেলে ভবিষ্যতে জেলায় পাহাড়ের চিহ্ন থাকবে না। এছাড়া বর্ষায় পাহাড়ধসে প্রাণহানির শঙ্কা থেকেই যায়। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ২৫টির বেশি পাহাড়ধসের ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পরও পাহাড় কাটা বা পাহাড়ে বাস থামেনি। উল্টো ৫০-৭০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া এবং পাদদেশে ঘরবাড়ি তৈরি হয় দেদারসে। পাহাড় কাটার মাটি বৃষ্টির সঙ্গে পৌরসভার ড্রেনে গিয়ে পড়ায় সামান্য বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।

পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা ছিদ্দিকী জামশেদ বলেন, পর্যটন শহর হিসেবে কয়েক লাখ ভাসমান মানুষ ঠাঁই নিয়েছে কক্সবাজারে। তারা কিংবা কোনো বিত্তবান খণ্ড খণ্ডভাবে পাহাড়ের অংশ কিনে তা কেটে ঘর তৈরি করছে। পাহাড় কাটার মাটি নেমে শহরের নালার পাশাপাশি ভরাট হচ্ছে বাঁকখালী নদীর তলদেশ। এভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে নৌচলাচলের পথ। বর্ষায় পাহাড়ধসে হতাহতের ঘটনা বাড়লেও পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না।

সূত্রমতে, যুগ যুগ ধরে কক্সবাজার শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে কয়েক লাখ মানুষ। এর মাঝে কক্সবাজার শহরেই ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার। তবে অনেকেই বলছে স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা শুধুমাত্র মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ থাকায় পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকানো যাচ্ছে না। আবার বনবিভাগ বা পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালালেও পাহাড় কাটা না থামায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।

মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ প্রশাসন, পাহাড়ধসে বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

আরও পড়ুন-
শরতের বৃষ্টিতেও ঢাকায় জলাবদ্ধতা, কাজে আসছে না কোনো উদ্যোগ
টঙ্গীর কেমিক্যালের গুদাম যেন মৃত্যুপুরী
গাছ কেটে সাবাড়, ধ্বংস চর বনায়ন

কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া, বৈদ্যঘোনা, পাহাড়তলী, সাহিত্যিকাপল্লী, লারপাড়া, আদর্শগ্রাম, টিঅ্যান্ডটি টাওয়ার, লাইট হাউস, সার্কিট হাউস, মোহাজেরপাড়া, নতুন পুলিশ লাইনের পেছন ও আশপাশ, কলাতলী, চন্দ্রিমা হাউজিং, দরিয়ানগর, টেকনাইফ্ফা পাহাড়, এবিসি ঘোনাসহ ২০-২৫টি এলাকায় পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে হাজারো মানুষ। পাহাড় কেটেই তাদের বসতি। তাদের অধিংকাশ এখনো পাহাড় কাটছে। সর্বশেষ গত ১৮ জুন ভোরে বৃষ্টির সময় রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়িতে পাহাড় কাটার সময় মাটিচাপা পড়ে এক যুবক নিহত হয়েছেন।

কক্সবাজার সদর ছাড়াও জেলায় পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে বাস রামু, ঈদগাঁও, উখিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফে। এসব পাহাড়ি এলাকার অধিকাংশই বন বিভাগের রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনভূমি।

মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ প্রশাসন, পাহাড়ধসে বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. তানহারুল ইসলাম বলেন, গত এক দশকে (২০১৫-২০২৫) ২১টি পাহাড় ধসের ঘটনায় কক্সবাজারে মারা গেছেন ৪৮ জন। এদের মাঝে ২৯ জন স্থানীয় আর ১৯ জন আশ্রিত রোহিঙ্গা। একুশটি পাহাড় ধসের ১০টি ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এসব পাহাড় ধসে ২৫-৩০ জন আহতও হয়েছিলেন। আর এসময়ে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে ১১৯টি পাহাড় ধসের ঘটনায় ২১৪ জন নিহত ও ১৩৩ জন আহত হন। ২০১৫ সালের আগের দশকে শতাধিক প্রাণহানির খবর আছে।

ডিএডি তানহারুলের মতে, অনুসন্ধানে বলছে বসতির জমি বের করতেই পাহাড় কাটার সময় গাছ-গাছালিও ধ্বংস হয়। ফলে বৃষ্টি হলেই সরে যায় পাহাড়ের মাটি। এভাবেই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হয়। পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে বসবাসকারীদের সমতলে পুনর্বাসন করে পাহাড়ের বসতি গড়ার বিষয়ে কঠোরতা দরকার। নইলে পাহাড় ধস ও মৃত্যু থামানো যাবে না।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের কক্সবাজার রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. হাবিবুল হক জানান, কক্সবাজার শহর কেন্দ্রিক কলাতলী, ঝিলংজা, চাইন্দা ও হিমছড়ি বনবিট এলাকায় পাহাড় কাটার দায়ে গত এক দশকে ৩৭টি পিওআর মামলা করা হয়েছে। এতে আসামি ৬৭ জন। এছাড়াও দক্ষিণের অপরাপর রেঞ্জগুলোতেও আরও ১৫-২০টি মামলা করা হয়। ‘গডফাদার’রা আড়ালে থাকে, অভিযানে গেলে পাহারাদার বা শ্রমিকই ধরা পড়ে জেলে যায়। তখন অন্য শ্রমিক দিয়ে কাজ চলে। ‘গডফাদার’ শনাক্ত হয় না বলে পাহাড় কাটাও বন্ধ হয় না।

মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ প্রশাসন, পাহাড়ধসে বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

কক্সবাজার পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা সৈয়দুল হক আজাদ বলেন, পাহাড়ধসের শঙ্কায় ঝুঁকিতে বসবাসরতদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। আমরা মাইকিং করি, এরপরও সরে না গেলে জোর করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্যোগ চলে গেলেই তারা পুনরায় সেই ঝুঁকিতে চলে যায়। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় থাকে বলে, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাস থামানো কষ্টসাধ্য। তবে শুষ্ক মৌসুমে রুটিন করে পৌরসভা-জেলা প্রশাসন ও শৃংখলাবাহিনী যৌথ অভিযান চালালে, সফলতা আসতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জমির উদ্দিন জানান, জেলায় পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অসংখ্য মানুষ বাস করছে। বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ি মাটি ভাসিয়ে দেওয়া হয়। পাহাড় কাটাসহ নানা অভিযোগে গত এক দশকে ১৮৮টি মামলা করা হয়েছে। অভিযানে জব্দ করা হয়েছে পাহাড় কাটার অনেক সরঞ্জামও। এতকিছুর পরও পাহাড় কাটা বন্ধ করা কঠিন।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দিপু বলেন, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে, ভরাট হচ্ছে সাগরের তলদেশ। সেখানে পাহাড়ের মাটি উপকূল ভরাট আরও তরান্বিত করছে। অভিযোগ উঠছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিহ্নিত কিছু দুর্নীতিবাজ পাহাড় খেকোদের নানা ভাবে সহযোগিতা দেয়। এ কারণে পাহাড় কাটা বন্ধ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে প্রশাসনের আরও কঠোরাতা দরকার।

মাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ প্রশাসন, পাহাড়ধসে বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল

তথ্য বলছে, কক্সবাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১০ সালের ১৫ জুন। ওইদিন ভোরে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জেলায় পাহাড়ধসের ঘটনায় অকালে ঝরে পড়েছিল সেনাবাহিনীর ৬ সদস্যসহ ৫৪টি তাজা প্রাণ। এর আগে ২০০৮ সালের ৪ ও ৫ জুলাই টেকনাফের টুইন্যারপাহাড় ও ফকিরামুরা এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনায় একই পরিবারের ৪ জনসহ ১৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালের ২২ জুন রাতে ভয়াবহ পাহাড়ধস, চাপা, বজ্রপাত ও পানিতে ডুবে মারা যান ৪৯ জন। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হলেও পাহাড় থেকে সরানো যাচ্ছে না অবৈধ বাস।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক এম এ মান্নান বলেন, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিয়ে শুষ্ক মৌসুমে তেমন ভাবা হয় না। কিন্তু ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসের শঙ্কা তৈরি হলে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকাতে ঝুঁকিতে থাকাদের নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। প্রয়োজনে যৌথ অভিযানও চালানো যায়। সকল বিষয়ে প্রশাসন সতর্ক রয়েছে।

এফএ/এএসএম