গাছ কেটে সাবাড়, ধ্বংস চর বনায়ন

আহসানুর রহমান রাজিব
আহসানুর রহমান রাজিব আহসানুর রহমান রাজিব , সাতক্ষীরা সাতক্ষীরা
প্রকাশিত: ১০:২৮ এএম, ০৬ অক্টোবর ২০২৫

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের খোলপেটুয়া নদীর তীরে প্রায় ৩০০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা চর বনায়ন এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রতিদিন নির্বিচারে কাটা হচ্ছে বনাঞ্চলের হাজারও গাছ। কোথাও গাছ কেটে ফেলে রাখা হচ্ছে, আবার জোয়ারের সময় নৌকায় করে পাচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি গর্ত খুঁড়ে মাছ শিকারের ফাঁদ বসানোয় নতুন গাছ জন্মাচ্ছে না। অথচ বহু বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাচীর হিসেবে উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষা করে আসছে এই বন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, দুই ইউনিয়নের সঙ্গবদ্ধ কয়েকটি চক্র দিন-রাত করাত আর কুঠার চালিয়ে গাছ কেটে নিচ্ছে। কাঠ বিক্রি করে তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছে। আর নদীর চরে মাছ ধরার সুবিধার্থে গর্ত খুঁড়ে রাখা হচ্ছে, যেখানে জোয়ারের সময় রেণু আটকে যায়। পরে সেগুলো ধরে বাজারে বিক্রি করা হয়। ফলে একদিকে গাছ উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন চারাগাছেরও জন্ম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

গাছ কেটে সাবাড়, ধ্বংস চর বনায়ন

স্থানীয় লোকজন জানান, খোলপেটুয়া নদীতে প্রায় ৭০০ বিঘা জায়গাজুড়ে প্রথমে গ্রামবাসীর উদ্যোগে বনায়ন শুরু হয়। পরে নদীর জোয়ারে ভেসে আসা নানা প্রজাতির বীজ ও ফল থেকে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠে ঘন সবুজ বন। এ বন দীর্ঘদিন ধরে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙন থেকে চরপাড়ের মানুষকে রক্ষা করেছে। কিন্তু গাছ কাটা অব্যাহত থাকলে বনায়ন পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা তাদের।

আরও পড়ুন
গাছ কেটে ছায়া খুঁজি
পাহাড় কাটা-পুকুর ভরাটে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য
চরের জমির মালিকানা দাবি করে প্রাকৃতিক বন উজাড়

পাতাখালী গ্রামের খোকন সরদার বলেন, আগে চরে প্রচুর গাছ ছিল। এখন প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়েছে। রাতে বা দিনে করাত দিয়ে গাছ কেটে রেখে যায়, পরে সেগুলো সরিয়ে নেয়। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় গাছটা মরে গিয়েছিল, তাই কাটা হয়েছে।

স্থানীয় তরুণ মোস্তফা আল আমিন বলেন, গাছ কাটা আর মাছ শিকারিদের দৌরাত্ম্যে নতুন গাছ জন্মাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আর বন টিকবে না। অথচ এ বন আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কয়েকটি পরিবার সরাসরি গাছ কেটে বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে চিহ্নিত মাদকসেবীরাও রয়েছে, যারা মাদক কেনার টাকা সংগ্রহে বন উজাড় করছে। আবার কেউ কেউ কেউড়া ফল সংগ্রহের নামে বড় বড় গাছ কেটে নিচ্ছে।

পশ্চিম পাতাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসএম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ২৫ থেকে ৩০ জন স্থানীয় বাসিন্দা প্রকাশ্যে বন কেটে নিচ্ছে। রেণু ধরার সুবিধার্থে শতাধিক গর্ত খোঁড়া হয়েছে। আগে একটি কমিটি বন রক্ষার দায়িত্বে থাকলেও এখন আর তা নেই। সেই সুযোগে চলছে নির্বিচার গাছ কাটা।

গাছ কেটে সাবাড়, ধ্বংস চর বনায়ন

পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী পরিচালক সোহানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বনের ভেতরে গর্ত করে মাছের পোনা ধরা আর নির্বিচারে গাছ কাটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। এতে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে, নতুন গাছ জন্ম নিচ্ছে না। অথচ এসব চর বন উপকূল রক্ষার প্রাকৃতিক বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদুল ইসলাম বলেন, চরে গড়ে ওঠা বনায়নের গাছ কেটে নেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিছু দুর্বৃত্ত চুরি করে এসব গাছ পাচার করছে। আমরা জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা করছি।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনী খাতুন বলেন, এ ধরনের বেআইনি গাছ কাটার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। সামাজিক বন বিভাগকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে প্রশাসনও সরাসরি ব্যবস্থা নেবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চর বন ধ্বংস হলে খোলপেটুয়া নদীর তীরবর্তী এলাকা ভাঙনের মুখে পড়বে। বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে পড়বে। বাড়বে জলোচ্ছ্বাস ও দুর্যোগের ঝুঁকি। তাই স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক বন বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই চর বনায়ন রক্ষা সম্ভব নয়।

আরএইচ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।