পাবনা জেনারেল হাসপাতাল
লোডশেডিংয়ে থেমে থাকে অপারেশন, ৯ বছরেও চালু হয়নি আইসিইউ
প্রতিষ্ঠার পর আজও চালু হয়নি আইসিইউ/ছবি-জাগো নিউজ
‘রোগীর দশা’ থেকে বের হতে পারছে না উনিশ শতকে স্থাপিত পাবনা জেনারেল হাসপাতাল। ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিভাবে উদ্বোধন করা হলেও আজও চালু হয়নি আইসিইউ। দীর্ঘদিন অকেজো রয়েছে জেনারেটর ব্যবস্থা। ফলে লোডশেডিংয়ে অপারেশন বন্ধ করে বসে থাকতে হয় চিকিৎসকদের।
বিশৃঙ্খলা, অপরিচ্ছন্নতা, ওষুধ, বেড ও চিকিৎসক সংকটসহ আরও রয়েছে নানান সমস্যা। হাসপাতালে প্রকট আকার ধারণ করেছে দালালদের দ্বারা রোগী ও স্বজনদের হয়রানি। দীর্ঘসময় ধরে এসব সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্টরা দাবি জানালেও আজও মেলেনি প্রতিকার। ফলে ভোগান্তির শেষ নেই সেবাপ্রত্যাশীদের।
হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ১৯১৯ সালে জমিদার হেমাঙ্গিনি দেবীর নামে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনের মধ্যদিয়ে হাসপাতালটির যাত্রা শুরু হয়। এরপর ওই শতকের ষাটের দশকে এটিকে ১০০ শয্যা ও পরে ২০০৯ সালে পূর্ণরূপে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে কার্যক্রম শুরু হয়। সময় পরিবর্তনে টুকটাক বরাদ্দ বাড়ালেও হাসপাতালে সেবার মান বাড়েনি।

জেলার প্রায় ২৮ লাখ লোকের চিকিৎসায় একমাত্র ভরসাস্থল পাবনা জেনারেল হাসপাতাল। বর্তমানে এ হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি ও বহির্বিভাগ মিলিয়ে পাবনার ৯টি উপজেলার দুই থেকে তিন হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। কিন্তু বরাদ্দ ও জনবল সংকটসহ নানান সমস্যায় কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। জেনারেটর ব্যবস্থা সচল না থাকায় লোডশেডিং হলে অনেক সময় অপারেশন বন্ধ করে বিদ্যুতের আশায় বসে থাকতে হয় চিকিৎসকদের।
আইসিইউ ইউনিট চালু না থাকায় মিলছে না সেবা। হৃদরোগীদের জন্য ২০ শয্যার সিসিইউ চালু থাকলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় সেবা দেওয়া হচ্ছে মাত্র আটজন রোগীকে। কারিগরি সুবিধা না থাকায় অকার্যকর পোস্ট অপারেটিভ ইউনিট।

হাসপাতালে বিভিন্ন সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করলেন অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সিরাজুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইসিইউ পরিচালনায় একটি সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষিত দলের প্রয়োজন হয়। তেমন দক্ষ জনবল আমরা কখনোই পাইনি। হাসপাতালে পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটই নেই। দক্ষ জনবল, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাবে অপারেশনের সময় নানা সমস্যায় পড়তে হয়। জেনারেটর অকেজো। ফলে লোডশেডিংয়ে অপারেশন বন্ধ করে বসে থাকতে হয়।’
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় আইসিইউ চালু সম্ভব হয়নি। অতিরিক্ত রোগীর চাপে ২০ শয্যার সিসিইউ ইউনিট করা হয়েছে। কিন্তু মনিটরসহ অনেক যন্ত্রাংশ না থাকায় তার সুফল মিলছে না। অনেক যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। বরাদ্দ সংকটে তা নতুন করে কেনা সম্ভব হয়নি।’

রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্যাথলজি পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও উপকরণ সংকটে সেবা পান হাসপাতালে আসা মাত্র ২০ শতাংশ রোগী। ফিল্ম সংকটে বছরের কয়েক মাস পরীক্ষা চললেও বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে সিটিস্ক্যান ও এক্সরে পরীক্ষা। ফলে বাধ্য হয়ে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণসহ গুরুতর রোগীদের চড়া মূল্যে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করাতে হয়। এতেও রয়েছে দালালের উৎপাত। রোগীর স্বজনদের বিভ্রান্ত করে প্রতারণা করা হয় তাদের সঙ্গে। নামকাওয়াস্তে কখনো দু-একটি ওষুধ পাওয়া গেলেও তা সব সময় মেলে না।
কথা হয় শহরের নিকটবর্তী এলাকা দোগাছি থেকে রোগী নিয়ে আসা মো. নাজমুলের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডায়রিয়ার স্যালাইন সাধারণত হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু সেটাও ঠিকভাবে মেলে না এই হাসপাতালে। কখনো থাকে আবার কখনো থাকে না। অনেক সময় থাকতেও বলে নেই। দালালদের হয়রানি তো আছেই। হাসপাতালে ঢুকতেই দালাল পিছু নেয়। হাসপাতালের কাউকে না পাওয়া গেলেও দালালরা বেড পাইয়ে দেওয়া, টেস্টের ব্যবস্থাসহ সব করিয়ে দিতে চায়। যারা তাদের ফাঁদে পা দেন, তাদের অনেক টাকা গচ্চা দিতে হয়।’

আটঘরিয়া থেকে আসা ভর্তি রোগীর স্বজন হানিফ বলেন, ‘সব বাইরে থেকে কিনে আনা লাগে। এটি নামে সরকারি হাসপাতাল। এখানে একটা সিরিঞ্জও মেলে না। ওষুধ তো নাই-ই।’
বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা রোগী সালাম মালিথা বলেন, ‘ভালো করে চোখে দেখি না। ডাক্তার দেখে দুইটা টেস্ট দিলো। এর একটি টেস্ট হাসপাতালে হলো। তাদের নাকি কালি শেষ হয়ে গেছে। তাই আরেকটি বাইরে থেকে করাতে বললো। আমি গরিব মানুষ। তাই এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছি। কিন্তু এখান থেকে পুরোপুরি সরকারি সেবা তো পেলাম না।’

আরেক রোগীর স্বজন মো. রেজাউল বলেন, ‘আমি শহরে থাকি। এলাকা থেকে অনেক সময় রোগী আসে। ফলে আমাকে মাঝে মধ্যেই হাসপাতালে আসতে হয়। পরীক্ষা করাতে গেলে দু-একটা হলেও বাকিগুলোর জন্য বাইরে যেতে হয়। দালালের উৎপাততো রয়েছেই। ট্রলি বা হুইল চেয়ার নিতে গেলেই টাকা গুনতে হবে।’
এ বিষয়ে পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রফিকুল হাসান বলেন, ‘২৫০ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন আট থেকে দশগুণ বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়। পরীক্ষা উপকরণ ও ওষুধ ক্রয়ে আমরা যে বরাদ্দ পাই, তা দিয়ে কেনা উপকরণে বছরের দুই মাসের বেশি চলে না। বাধ্য হয়েই পরীক্ষা বন্ধ রাখতে হয়। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই এর সমাধান হবে।’
এসআর/এএসএম