ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

কর্নেল জাফরের নেতৃত্বে আজ ফেনীতে উড়েছিল স্বাধীনতার পতাকা

জেলা প্রতিনিধি | ফেনী | প্রকাশিত: ১০:৪৩ এএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫

আজ ৬ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক ফেনী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙেছিল ফেনী। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাফর ইমাম বীর বিক্রমের নেতৃত্বে এদিন ফেনী শহরে উড়েছিল স্বাধীনতার প্রথম সূর্য। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনতার ঢল নেমেছিল বিজয় উল্লাসে। একাত্তরের সেই গৌরবোজ্জ্বল দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে ফেনীবাসী।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ফেনী জেলার (তৎকালীন ফেনী মহুকুমা) স্বাধীনতাকামী জনগণের রয়েছে অভাবনীয় বীরত্বগাঁথা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে তিন দিক থেকে ফেনীর রয়েছে সীমান্ত। ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফেনীতে ব্যাপক অত্যাচার নিপীড়ন ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ফেনী সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। তার মধ্যে শুভপুর ও বিলোনিয়া যুদ্ধ অন্যতম। ফেনীর রাজা খ্যাত খাজা আহম্মদের নেতৃত্বে ফেনীর মুক্তিযোদ্ধারা দেরাদুন ও চোত্তাখোলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ২ নম্বর সাব সেক্টর কমান্ডার জাফর ইমামের নেতৃত্বে বিলোনিয়া যুদ্ধ একটি অনন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদরের হাতে জিম্মি ছিল ফেনী। ফলে সেদিন সকালে ‘জয় বাংলা’ গান শুনে অনেকেই হতচকিত হয়ে ওঠেন। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এ গান প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি- সত্যিই তারা স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিলে দেখতে পান। তখন লোকজনের ভুল ভাঙতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাধারণ মানুষ মিছিলে যোগ দিতে শুরু করেন।

jagonews24

মুক্ত ফেনীতে সেদিন মানুষের দৃষ্টি ছিল ফেনী কলেজে। বিজয়ের একদিন আগে পাকিস্তানি আর্মি কলেজ ক্যাম্পাস ছেড়ে দেয়। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্প ও বহু শহীদের রক্তে রঞ্জিত বধ্যভূমি।

এ প্রসঙ্গে ফেনী কলেজের তৎকালীন দর্শন বিভাগের শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান বলেন, সেদিন মাঠের একদম দক্ষিণের গোলপোস্টের নিচে অনেক মরদেহ পেয়েছি। এক কোণে ২০-২৫টি মরদেহ দেখেছি। মরদেহ মানে হাড়গোড়ই ছিল শুধু। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে সাংবাদিকরা গিয়ে ছবি তুলে এনেছে। কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে, এখানে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গোলপোস্টের পেছনের অংশ ছাড়াও মাঠ লাগোয়া রেলওয়ের ডোবাতেও মরদেহ পঁচে-গলে ছিল। এখন যেখানে কলেজ অডিটোরিয়াম রয়েছে সেখানেও মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে।

jagonews24

৬ ডিসেম্বর সকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জাফর ইমামের লেখা ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ বইতে উল্লেখ করেন, বিজয়ের বেশে আমরা যখন ফেনী প্রবেশ করলাম, ক্ষণিকের মধ্যে শহরে জনতার ঢল এসেছিল। শুরু হয় বিজয় মিছিল। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। রাস্তায় জনগণ যেখানেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে সেখানেই তাৎক্ষণিক তারা আলিঙ্গন করে বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। অনেকে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে কোলে করে রাস্তা পরিদর্শন করছিল। রাস্তার দুপাশ থেকে জনতা দু’হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। মিছিলে মিছিলে শোভা পাচ্ছিল বাংলাদেশের পতাকা। অনেককে বিজয়ের আনন্দে কাঁদতে দেখেছি।

বইতে আরও উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে খাজা সাহেব (খাজা আহম্মদ) কিছুক্ষণ পর ফেনী পৌঁছেছিলেন। আমার সঙ্গে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর বৃহত্তর অংশ ফেনী প্রবেশ করে। ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের পেছন থেকে আমাদেরকে অনুসরণ করে ও ফেনী অভিমুখে যাত্রায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও ফেনী কলেজের প্রিন্সিপাল ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান খান, তৎকালীন ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবদীন হাজারী, গোলাম কাদের আরও অনেকেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন।

ফেনীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় একই সময়ে শহরে প্রবেশ করে ভিপি জয়নাল, করিম হাজারী, নুর মোহাম্মদ হাজারী, মো. সালেহ আহম্মদ সালু, আবদুল মোতলেব, কাজী নুর নবী, শ্যামল বিশ্বাস, অ্যাডভোকেট মুসা মিয়া, জাহাঙ্গীর কবির। সবাই সেদিন বিজয়ের আনন্দে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন।

jagonews24

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ফেনীর ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চার জন বীরউত্তম, সাত জন বীর বিক্রম এবং ২০ জন বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।

ফেনীর সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মোতালেব বলেন, প্রতিবছর ৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসছে। এই দিন মুক্তিযোদ্ধারা দিনটির কথা স্মরণ করে নানা আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটি পালন করেন।

এদিকে দিনটি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন আয়োজন করেছে নানা আয়োজন। এছাড়া বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠন ফেনী জেলা শহরে আলোচনা সভা ও বিজয় র‌্যালী বের করবে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি উদযাপনের নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।


আবদুল্লাহ আল-মামুন/কেএইচকে