যশোরের গদখালি
৫ দিবস টার্গেট, শতকোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা
ক্ষেতে ফুলগাছ পরিচর্যা করছেন চাষি/ছবি-জাগো নিউজ
‘ফুলের রাজধানী’ খ্যাত যশোরের গদখালিতে নতুন মৌসুম ঘিরে স্বপ্ন বুনছেন ফুলচাষিরা। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তায় এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বেচাকেনা। বাজারে উঠেছে রং-বেরঙের ফুল। ব্যবসায়ীরা সেই ফুল নিয়ে ছুটছেন দেশ-দেশান্তরে। নতুন বছরে পাঁচ দিবসকে ঘিরে শতকোটি টাকার ফুল বিক্রির প্রত্যাশা চাষি ও বিক্রেতাদের।
যশোরের নিভৃত জনপদ ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি এখন সারাদেশে ‘ফুলের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত। গদখালির বাহারি সব ফুলের সৌন্দর্য ও সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে। গদখালিসহ যশোরাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে নানা জাতের ফুলের চাষ হচ্ছে। এই অঞ্চলের চাষিদের উৎপাদিত প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ফুল চাষি-ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে পৌঁছে যায় সৌন্দর্যপিপাসুদের হাতে। বর্তমানে ফুলের অর্থনৈতিক বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি পর্যটনকে ঘিরে নতুনমাত্রা যোগ হয়েছে।
ঝিকরগাছা কৃষি অফিস ও ফুলচাষি-ব্যবসায়ীরা জানান, যশোরের শুধু গদখালি নয়, আশপাশের আরও কয়েকটি ইউনিয়ন এবং উপজেলাতেও গ্রামে গ্রামে ফুল চাষের বিপ্লব ঘটেছে। এই অঞ্চলে ছয় হাজারের বেশি চাষি দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফুল চাষ করছেন। এ অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম ফুল চাষ শুরু করেছিলেন পানিসারা গ্রামের কৃষক শের আলী সরদার। তিনি ১৯৮২ সালে এক বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা ফুল চাষ করেছিলেন। তার সফলতা দেখে পরবর্তীতে ধান, পাট কিংবা প্রচলিত শস্য চাষ ছেড়ে এলাকার চাষিরা ঝুঁকে পড়েন ফুলচাষে।
চার দশকের বেশি সময় ধরে সম্প্রসারিত হওয়া ফুলচাষ গদখালিকে এনে দিয়েছে ‘ফুলের রাজধানী’র খ্যাতি। এখন এই অঞ্চলের কৃষকরা নিত্যনতুন জাতের ফুল চাষে নজির স্থাপন করে চলেছেন। গদখালীর যেদিকেই চোখ যায়, চোখে পড়ে একটার পর একটা ফুলের বাগান। বিশেষ করে গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, অর্কিড, পাতাবাহারসহ অসংখ্য বাগান। এর বাইরেও চোখে পড়ে পলি হাউজ বা ফুলচাষের বিশেষ ঘর। এসব ঘরে চাষ হচ্ছে জারবার ফুল, বাজারে যার চাহিদা অনেক বেশি।

গদখালির ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘বাণিজ্যিক ফুলচাষের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঝিকরগাছার পানিসারা গ্রাম থেকেই। চার দশকেরও বেশি সময়ের এই যাত্রায় গদখালি এলাকার চাষিদের ফুলের বাজার বছরে ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গদখালি মোকামে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার ফুল বেচাকেনা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে গদখালিতে ফুলের পাইকারি মোকাম চালু হয়। এরপর তিনিসহ স্থানীয় চাষি-ব্যবসায়ীদের প্রচেষ্টায় এবং গণমাধ্যমের কল্যাণে এই বাজারের প্রচার ও প্রসার হয়েছে। নতুন নতুন জাত ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্যদিয়ে ফুল চাষে বিপ্লব হয়েছে।
যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে গদখালি বাজারে প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে বসে ফুলের মোকাম। এলাকার চাষিরা তাদের ক্ষেত থেকে উৎপাদিত ফুল নিয়ে হাজির হন সেখানে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। দর কষাকষির মাধ্যমে ফুল কিনে পৌঁছে দেন দেশ-দেশান্তরে। হেমন্ত থেকে শুরু করে শীতের মৌসুম এবং বসন্ত নাগাদ ফুলের বাজার জমজমাট থাকে। দেশের অন্যতম বৃহত্তম ফুলের মোকাম গদখালিতে বছরে ৪০০ কোটি টাকার বেশি ফুল হাতবদল হয়। দেশের চাহিদার বেশিরভাগ ফুল সরবরাহ করেন এই এলাকার চাষিরা।
গদখালি মোকামে ফুল বিক্রি করতে আসা চাষি সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শীতকালে ফুলের উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ে। এবছরও আমরা ফুল বিক্রির প্রস্তুতি নিয়েছি। বাজারে এখন গোলাপ ফুল বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে ছয় টাকা পিস। বর্তমানে বাজারে গোলাপ ও গাঁদা ফুলে দাম সবচেয়ে কম। বাকি সব ফুলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আশা করছি, বিজয় দিবস উপলক্ষে সবধরণের ফুলের দাম বাড়বে।’

তিনি আরও বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে ফুলের বাজার। দেশের পরিবেশ স্থিতিশীল থাকলে ফুলের বাজার চাঙা হবে।
আরও পড়ু্ন:
মহাসড়ক থেকে সরলো গদখালী ফুলের বাজার
ড্রিপ ইরিগেশন সেচ পদ্ধতিতে সুফল পাচ্ছেন চাষিরা
সোহেল রানা নামের আরেক চাষি বলেন, গতবছরের তুলনায় বাজার পরিস্থিতি এখনো ভালো আছে। আশা করছি, কিছুদিন পর বাজারে ফুলের দাম আরও বাড়বে। এভাবে বাজার স্থিতিশীল থাকলে চাষিদের খরচ পুষিয়ে যাবে।
অনলাইন ফুল সরবরাহ উদ্যোক্তা মো. আল আমিন জানান, বিগত বছরের মতো এবারও ব্যাপক ফুল সরবরাহের প্রস্তুতি নিয়েছেন চাষিরা। বাজারে ফুলের সরবরাহ বেড়েছে। বিজয় দিবসের আগে ফুলের বাজার আরও জমজমাট হবে। গদখালি মোকামের ফুলের চাহিদা সারাদেশেই আছে। এখান থেকে ফুল কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফুল বিক্রির ধুম পড়ে। এবারও মৌসুম জুড়ে ফুলের বাজার চাঙা হবে বলে আশাবাদী চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, মহান বিজয় দিবস, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও বসন্তবরণ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষবরণসহ ইংরেজি নববর্ষেও ফুলের বেচাকেনা বেড়ে যায়। এই দিবসগুলো ঘিরে বাজার ধরতে ব্যস্ততা বেড়েছে ফুলচাষিদের। রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানান প্রজাতির ফুলচাষিরা ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এবার বর্ষায় অনেক রজনীগন্ধা ফুলগাছ মারা গেছে। উৎপাদন কম হওয়ায় মৌসুমের শুরুতে রজনীগন্ধা ফুলের দাম সবচেয়ে বেশি। বিজয় দিবসের আগে সব ধরনের ফুলের দাম বাড়বে বলে আশা চাষিদের।
গদখালির ফুলচাষি ইসমাইল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা শীত মৌসুমের বিশেষ দিবসগুলো ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের জন্য চাষিরা কয়েক মাস আগে থেকেই ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এবার আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে ফুলের দামে ধস নেমেছে। বিশেষ দিবসগুলোতে ফুলের দাম বাড়বে কিনা সংশয় রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে ফুলের বাজার। তবুও আশা করছি বাজার ভালো হবে।’

ঝিকরগাছার কুলিয়া গ্রামের চাষি আরিজুল ইসলাম। এক বিঘা জমিতে রাজনীগন্ধা ফুলের চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এরইমধ্যে ফুল বিক্রি করেছেন প্রায় দুই লাখ টাকার। আশা করছেন, আরও প্রায় তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন।
আরিজুল ইসলাম বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতেই রজনীগন্ধা ফুলের দাম ভালো পাচ্ছি। বর্তমানে ১০-১২ টাকা পিস বিক্রি করলেও এ মৌসুমে সর্বোচ্চ ২১ টাকা পিস বিক্রি করেছি।’
পটুয়াপাড়া গ্রামের চাষি তৈয়ব আলী বলেন, এক বিঘা জমিতে গোলাপ চাষে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। গোলাপ ফুলের উৎপাদন বেশি। বাজারে গোলাপের সরবরাহ বেশি হওয়ায় দাম কমেছে। গাঁদা ফুলের দামেও ধস নেমেছে। আশা করছি, বিজয় দিবসের আগে আবার ফুলের দাম বাড়বে।
গদখালি ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবু জাফর জানান, এই অঞ্চলে ফুলের বাজার ৪০০ কোটি টাকার। শীতের শুরু থেকেই ফুলের বাজার জমতে শুরু করেছে। চাষিরা তাদের শ্রমের ফসল ফুল বাজারে তুলতে শুরু করেছেন। ফুলের বাজারও ভালো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ভালো দাম পাবেন বলে আশা করছেন চাষিরা। সবমিলিয়ে তাদের আশা, মৌসুমের পাঁচটি দিবসকে ঘিরে তারা শতকোটি টাকার ফুল বেচাকেনা করতে পারবেন।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম বলেন, মৌসুমের শুরু থেকেই ফুলের বাজার ধরতে চাষিরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছেন। ফুল চাষের ক্ষেত্রে ছত্রাকসহ যে ধরনের রোগ-বালাইয়ের সমস্যা দেখা দেয়, তার জন্য সবসময়ই তারা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছেন। বাজার পরিস্থিতিও ভালো। আশা করা হচ্ছে, গদখালির চাষিরা এই মৌসুমে যথেষ্ট লাভবান হতে পারবেন।
এসআর/এমএস