ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ব্যবস্থাপনার অভাবে পেছনে পড়ছে বিশ্ব ঐতিহ্যের পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার

আরমান হোসেন রুমন | নওগাঁ | প্রকাশিত: ১২:১০ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। যার অবস্থান ইতিহাস ও ঐতিহ্যের লীলাভূমি উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায়। এটি দেখতে প্রতিনিয়ত দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন দেশি-বিদেশি হাজারো পর্যটক। স্থানটিকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে কয়েকশ বেকার যুবকের। তবে দর্শনার্থীদের নানাভাবে হয়রানির অভিযোগও রয়েছে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে।

দর্শনার্থীদের অভিযোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় রেলপথ ও সড়কপথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার দেখতে আসেন বিদেশি পর্যটকরা। কিন্তু তাদেরকে সহযোগিতা না করে উল্টো এ অঞ্চলের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা জিম্মি করে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আদায় করেন। বিহার সংলগ্ন হোটেলগুলোতে খাবার খাওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের থেকে নেওয়া হয় অতিরিক্ত টাকা। ফটোগ্রাফার সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে সর্বস্বও খোয়াতে হয় অনেক সময়।

সরেজমিন পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে গেলে বেশ কিছু অব্যবস্থাপনা নজরে আসে প্রতিবেদকের। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতা শোনেন এই প্রতিবেদক। ইউনেস্কো স্বীকৃত এ নিদর্শনটি আবিষ্কারের ১৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যটকদের সুবিধার্থে সেখানে কোনো হোটেল নির্মাণ করেনি বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। সুনজর নেই পর্যটন বোর্ডেরও। রাত্রিযাপনের সুবিধা না থাকায় বিষয়টি নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়তে হয় দূর দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন বিদেশি পর্যটকরা। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা শিক্ষা সফরে আসছেন, তাদের মধ্যাহ্নভোজের সময় কুকুরের বহরকে পাশ কাটিয়ে খাবার খেতে পড়তে হচ্ছে চরম বেকায়দায়। কেউ প্লেট হাতে নিয়ে খেতে বসলেই বেওয়ারিস কুকুরের দল চারিদিক ঘেরাও করে। এতে বাধ্য হয়ে অনেক সময় দাঁড়িয়ে প্লেট হাতে খেতে হয় দর্শনার্থীদের।

ব্যবস্থাপনার অভাবে পেছনে পড়ছে বিশ্ব ঐতিহ্যের পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জয়পুরহাট থেকে ঘুরতে আসা এক যুগল বলেন, ‘দূরত্ব কম হওয়ায় অবসর সময়ে মাঝেমধ্যেই পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ঘুরতে আসি। তবে কয়েক মাস আগে এখানে ঘুরতে এসে ভয়ংকর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এক ফটোগ্রাফার আমাদের অজান্তে কিছু ছবি উঠিয়ে কাছে এসে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। দাবিকৃত টাকা না দিলে ছবিগুলো ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে পকেটের সব টাকা দিয়ে ছবিগুলো ডিলিট করিয়েছি।’

রাজশাহী শহর থেকে আসা দর্শনার্থী বকুল হোসেন বলেন, ‘ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার দেখতে ১৫ জন যৌথ সফরে এসে পার্শ্ববর্তী রুচিতা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে ভাত, ডাল, ভাজি, খাসি ও গরুর মাংস খাওয়ার পর বিল দিতে গেলে আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন হোটেলের কর্মচারীরা। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি প্লেট ভাত ২০ টাকা এবং ভাজি ১০ টাকা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জোরপূর্বক আমাদের থেকে প্রতি প্লেট ভাতের দাম ২৫ টাকা এবং ভাজির দাম ১৫ টাকা করে নিয়েছে। খাবারের মান খুব একটা ভালো ছিল না।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রুচিতা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ক্যাশে বসে থাকা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘হোটেলে এসে তারা বেশি খাবার খাওয়ার শর্তে কম দাম নেওয়ার চুক্তি করেছিল। পরবর্তীতে তারা খুব বেশি খাবার অর্ডার না দিয়ে বেশিরভাগই ভর্তা, ডাল ও ভাত খেয়েছে। তাই কম দাম নেওয়া হয়নি। তাদের জিম্মি করে খাবারের বাড়তি দাম নেওয়ার অভিযোগটি সঠিক নয়। দুর্ব্যবহার করার প্রশ্নই আসে না।’

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ঘুরতে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুব হাসান রিফাত বলেন, ‘দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা এলেও এখানে রাত্রিযাপনের কোনো সুবিধা নেই। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কিছু রেস্ট হাউজ থাকলেও সেখানে প্রশাসনের অনেক বড় কর্মকর্তাদের রেফারেন্স নিয়ে আসতে হয়। সবার পক্ষে সেই রেফারেন্স নেওয়া সম্ভব নয়। তাই এই সিস্টেমে একটা পরিবর্তন এনে সবার জন্য রেস্ট হাউজ উন্মুক্ত করলে সুবিধা হয়। সেইসঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে একটি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করতে হবে।’

ব্যবস্থাপনার অভাবে পেছনে পড়ছে বিশ্ব ঐতিহ্যের পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার

একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুরতে আসা আরেক শিক্ষার্থী আশিক বলেন, ‘পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের পার্শ্ববর্তী অস্থায়ী দোকানগুলোতে খাবারের দাম অনেক বেশি নেওয়া হচ্ছে। ২৫ টাকার কোমল পানীয় ৪০ টাকা নিচ্ছে। দর্শনার্থীদের জন্য এটি অনেক ভোগান্তির। এসব দোকান ভেতরে এনে নজরদারিতে রাখলে সুবিধা হতো। মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা ১০ টাকার টিকিটে প্রবেশের সুবিধা পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৩০ টাকার টিকিটে প্রবেশ করতে হচ্ছে। এখানেও পরিবর্তন আসা উচিত। কারণ ছাত্রজীবনে আমরাও বেকার।’

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিক আশরাফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়; পুরো বিশ্বের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্তরিক হলেও এ অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দাদের মানসিকতা এখনো পর্যটকবান্ধব হতে পারেনি। বিদেশি পর্যটকদের জিম্মি করে তারা কয়েকগুণ বেশি ভাড়া নিচ্ছে। এতে বিদেশে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাই স্থানীয়দের পর্যটকবান্ধব করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। নয়তো আগামীতে হুমকির মুখে পড়তে পারে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের পর্যটনশিল্প।’

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে, পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে অথবা নবম শতাব্দীর শুরুর দিকে ৭০ দশমিক ৩১ একর জমির ওপর এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেছিলেন। এর প্রাচীন নাম ‘সোমপুর বিহার’। ১৮৭৯ সালে স্যার আলেকজান্ডার কাইনহম প্রথম এই নিদর্শনটি আবিষ্কার করেন। ইউনেস্কোর মতে দক্ষিণ হিমালয়ের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ বৌদ্ধবিহার এই পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কারণে মহাবিহারটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও আজও এই অপূর্ব বিহারটি এশিয়ার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বৌদ্ধবিহার হিসেবে সগৌরবে দণ্ডায়মান। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সেখানে ১টি জাদুঘর, ৩টি রেস্টহাউজ, ১টি ডরমেটরি ভবন ও কয়েকটি প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করেছে।

সার্বিক বিষয়ে কথা হলে পাহাড়পুর প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মুহাম্মদ ফজলুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছর কয়েক লাখ দর্শনার্থী এখানে ঘুরতে আসেন। যার মধ্যে অনেক বিদেশি পর্যটক রয়েছে। তাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। পর্যটকদের গাইড সেবাও দেওয়া হয়। ছোট খাটো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরই মধ্যে বিহারের ভেতরে পেশাদার ফটোগ্রাফারদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে ঘুরতে আসেন। তাদের মধ্যে বিদেশি পর্যটকদের অনেকেই রাত্রিযাপন করতে চান। আবাসিক সুবিধা দেওয়া প্রতœতত্ত্¦ অধিদপ্তরের আওতাধীন নয়। হেরিটেজ সাইট রক্ষা করে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করাই আমাদের কাজ। এরপরেও গবেষকদের সীমিত পরিসরে থাকার জন্য আমাদের কয়েকটি রেস্ট হাউজ রয়েছে। সেটি দর্শকদের থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। এ বিষয়টি পর্যটন কর্পোরেশন এবং পর্যটন বোর্ডকে অবহিত করা আছে। বেসরকারিভাবে কেউ হোটেল করার উদ্যোগ নিলে তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে।

এফএ/জেআইএম