ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

উপজেলা প্রতিনিধি | ঈশ্বরদী (পাবনা) | প্রকাশিত: ০৮:৫৭ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। ওই দিন হঠাৎ পাবনার ঈশ্বরদীর আকাশে প্রচণ্ড শব্দে গর্জে ওঠে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ বিমান। পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে সে বিমান থেকে বোমা ফেলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যান ভেঙে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে নীরব দাঁড়িয়ে আছে সেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধারা জানান, পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও কুষ্টিয়া থেকে রেললাইন পথ দিয়ে পালাতে শুরু করে। ১৪ ডিসেম্বর বিপুলসংখ্যক পাক সেনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অতিক্রম করে পাকশী হয়ে ঈশ্বরদী দিকে প্রবেশ করতে শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ভারতীয় বিমান বাহিনীকে জানালে তারা ব্রিজে বোমা নিক্ষেপ করে। এসময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজে থাকা পাক সেনাদের অনেকের মরদেহ ব্রিজের বিদ্যুৎ সংযোগের তারের সঙ্গে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। পাকিস্তানি সেনাদের ফেলে যাওয়া একটি ট্যাংক ব্রিজের ওপর পড়ে ছিল।

প্রত্যক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, যশোর ক্যান্টনমেন্ট মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী দখল নেওয়ার পর পাকিস্তানি শতশত সেনা সদস্যরা যশোর থেকে ঈশ্বরদী অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। এসময় কুষ্টিয়া ও আশপাশের পরাজিত পাক সেনারাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ফলে বিশাল পাক বাহিনীর বহর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে ঈশ্বরদীর অভিমুখে আসার খবর পেয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর হার্ডিঞ্জ ব্রিজে পরপর কয়েকটি বোমা নিক্ষেপ করে। বোমা নিক্ষেপের পর ধুলা ও ধোঁয়ায় চারদিকে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ধোঁয়া সরে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যান ভেঙে পড়ে আছে। বিমান থেকে ফেলা একটি বোমা বালুর মধ্যে পড়ে। স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা বোমাটি বালুর ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটায়। সেই বোমার খোলসটি পাকশী বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঈশ্বরদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল খালেক বলেন, ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। সে সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্র বাহিনী একত্রিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। যশোর ও কুষ্টিয়ার দিশাহারা পাক বাহিনী একত্রিত হয়ে সাঁজোয়া যান নিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পাড় দিয়ে উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করতে থাকে। আমরা ঈশ্বরদী ও পাকশীর মুক্তিবাহিনী বিষয়টি জানার পর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন পদ্মার তীরে অবস্থান করি। এসব পাক বাহিনীর গতিরোধ করার পরিকল্পনা করতে থাকি। এসময় হঠাৎ দেখতে পাই হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে বিমান উড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিমান থেকে ১২ নম্বর স্প্যানে বোমা ফেলা হয়। সঙ্গে সঙ্গে স্প্যান ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। ব্রিজের ওপরে থাকা কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নদীতে পড়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

পাকশীর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আগ্রাসন দমাতে ভারতীয় বিমান বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রিজে বোমা নিক্ষেপ করে ১২ নম্বর স্প্যান ভেঙে দেয়। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যান পুনরায় নির্মাণসহ ব্রিজ মেরামত করে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী (ডিএন-২) নাজিব কায়সার বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে চারদিকে যখন বিজয় ধ্বনি চলছিল। খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া যখন মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় অর্জন করে। তখন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে তাদের সাঁজোয়া যান ও অস্ত্র নিয়ে দক্ষিণাঞ্চল থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পাড়ি দিয়ে ঈশ্বরদী দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। পাক বাহিনীর গতিরোধ করতে ভারতীয় বিমান বাহিনী ১২ নম্বর স্প্যানের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে ভেঙে দেয়। ফলে পাকিস্তানি বিশাল সাঁজোয়া যানসহ বাহিনী অগ্রসর হতে পারেনি। স্বাধীনতার পর ৪ বছর এ ব্রিজ দিয়ে ট্রেন চলাচল করতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট ভারত সরকারের সহায়তার এ ব্রিজের ১২ নম্বর নির্মাণ ও ব্রিজ মেরামতের পর পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) লিয়াকত শরীফ খান জানান, স্বাধীনতার প্রাক্কালে পাকিস্তানি বাহিনীকে রুখে দিতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বোমা নিক্ষেপ করে ভারতীয় বিমান বাহিনী। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে পাকিস্তানি বাহিনী ঈশ্বরদীর দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। সেই বোমার একটি (নিষ্ক্রিয়) পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। কালের সাক্ষী হিসেবে এ বোমাটি এখানে সংরক্ষিত আছে। এটি দেখে নতুন প্রজন্ম ধারণা করতে পারে ৭১ সালে যুদ্ধ কতটা ভয়াবহ হয়েছে। তখনকার যুদ্ধে কী ধরনের বোমা ব্যবহার করা হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও সংরক্ষিত বোমা মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

শেখ মহসীন/এমএন/জেআইএম