পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে কাপ্তাই হ্রদে ছুটে চলা হাউজবোট
দৃষ্টিনন্দন আধুনিক সব সুবিধা থাকায় সব বয়সী পর্যটকদের কাছে সাড়া ফেলেছে এসব হাউজবোট/ছবি-জাগো নিউজ
- প্রতিটি হাউজবোটে রয়েছে আধুনিক শৌচাগার-ডাইনিংসহ খেলার ব্যবস্থা
- বর্তমানে চালু আছে ১৫টি হাউজবোট, যার প্রায় সবই দ্বিতল
- একসঙ্গে ভ্রমণ করতে পারবেন ২৫ জন পর্যটক
- প্যাকেজ ভেদে খরচ ৫০-৭০ হাজার টাকা
দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙ্গামাটির বিশাল এলাকাজুড়ে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে কাপ্তাই হ্রদের বয়ে চলা। এখানকার সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়ি গ্রাম আর নীল জলের সৌন্দর্যের টানে পর্যটকদের আগ্রহ দিনদিন বেড়ে চলেছে। একসময় ট্যুরিস্ট বোট ভাড়া করে দিনের বেলা ঘুরে বেড়ানো যেত কাপ্তাই হ্রদে। এখন পর্যটকদের কাছে নতুন আকর্ষণ হয়ে ধরা দিয়েছে হাউজবোট।
দৃষ্টিনন্দন আধুনিক সব সুবিধা থাকায় সব বয়সী পর্যটকদের কাছে সাড়া ফেলেছে এসব হাউজবোট। বিশাল নৌকার ওপর খোলা ছাদে বসে কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ যেমন করা যায়, তেমনি এসব হাউজবোটে আধুনিক বেডরুম, বেলকনি, রেস্তোরাঁসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার কমতি নেই; যেন ভাসমান হোটেল। এখন শুধু দিনের আলোতে নয়, পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্নার আলোতেও ঘুরে বেড়ানো যায় কাপ্তাই হ্রদের বুকে।

সুবলং ঝরনা, ঝুলন্ত সেতু, পলওয়েল পার্ক, বনভান্তের স্মৃতি মন্দির, রাজবন বিহার, চাকমা রাজার বাড়িসহ দর্শনীয় প্রায় সবগুলো স্পটে নিয়ে যাবে এসব হাউজবোট। এছাড়া পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্যেও ছুটে বেড়ায় এগুলো।
হাউজবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, কাপ্তাই হ্রদে থাকা ১৫টি হাউজবোট পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। প্রতিটি হাউজবোটে আধুনিক শৌচাগার, ডাইনিং, দাবা, লুডু, কেরাম খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। সরবরাহ করা হয় উন্নতমানের খাবার। সকালে খিচুড়ি, ডিম, চাটনি ও চা; দুপুরে ভাত, বাঁশে রান্না করা মুরগি, সবজি, ডাল ও সালাদ; বিকেলে চা, বিস্কুট বা মুড়িমাখা এবং রাতে বারবিকিউ পরিবেশন করা হয়। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী পাহাড়ি সবজি ও হ্রদের মাছও যোগ করা হয়।

রাজধানী ঢাকা থেকে বন্ধুদের একটি দল নিয়ে রাঙ্গামাটি বেড়াতে এসেছেন ব্যাংকার ইমরান জুয়েল। তিনি বলেন, ‘রাঙ্গামাটি আগেও বেড়াতে এসেছি অনেকবার। তবে এবার আসার উদ্দেশ্য হাউজবোটে ঘুরে বেড়ানো। হাউজবোটে রাত্রিযাপন এবং দিনভর ঘুরে বেড়ানো অন্যরকম এক আনন্দের। বোটে থাকা, খাওয়াসহ বিনোদনের নানা ব্যবস্থা আছে। বন্ধু, পরিবার-পরিজনসহ নিরাপদে পর্যটকরা হাউজবোটে ঘুরে বেড়াতে পারেন। হাউজবোটগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং পর্যটকদের সেবা দেওয়ার মান অত্যন্ত চমৎকার।
দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হাউজবোট।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কাপ্তাই হ্রদে হাউজবোট ব্যবসা শুরু হয় ২০১৯ সালে ‘প্রমোদিনী’ নামের একটি বোট চালুর মধ্য দিয়ে। পরে ‘মাউরুম’, ‘রাঙাতরি’, ‘স্বপ্নডিঙি’, ‘লুসাই দ্য ওয়াটার ভিলা’, ‘রয়েল অ্যাডভেঞ্চার লাক্সারি হাউজবোট’সহ যুক্ত হয়েছে একাধিক বোট। বর্তমানে এখানে চালু আছে ১৫টি হাউজবোট, যার প্রায় সবই দ্বিতল।
হাউজবোটে একদিন, এক রাত অথবা দুদিন এক রাতের প্যাকেজে ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। প্যাকেজে সাধারণত ঘুমানোর জন্য ছয়টি কক্ষে ১২ জন থাকার ব্যবস্থা থাকে। ভাড়ার মধ্যে থাকে খাবার ও হ্রদজুড়ে ঘোরাঘুরি। চুক্তিভিত্তিক ভাড়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, ২৫ জন পর্যন্ত পর্যটক একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, ভ্রমণসুবিধাসহ এক রাত এক দিনের জন্য হাউজবোট ভাড়া পড়ে ৫০ হাজার টাকা। খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু বোট ভাড়া ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। পুরো বোট দুদিন এক রাতের প্যাকেজে নিলে খরচ হয় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা।
হাউজবোটের চাহিদা বাড়ায় আরও নতুন নতুন হাউজবোট তৈরি হচ্ছে বলে জানান উদ্যোক্তারা। তাদেরই একজন বনকুসুম বড়ুয়া বাপ্পী জানান, কাপ্তাই হ্রদের হাউজবোট পর্যটকদের কাছে নতুনত্ব এনে দিয়েছে। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের একটা বড় অংশ হাউজবোটে বেড়াতে আগ্রহী থাকেন। তবে চাহিদার তুলনায় এখনো পর্যাপ্ত হাউজবোট নেই এখানে। পর্যটকদের চাহিদা থাকায় এখনো নতুন নতুন হাউজবোট তৈরি হচ্ছে। আমার নিজের একটি নতুন বোট তৈরির কাজ চলছে। আরও একজন উদ্যোক্তা একটি বড় হাউজবোট তৈরি করেছেন। এখন ডেকারেশনের কাজ চলছে। শিগগির পর্যটকদের জন্য এটি উদ্বোধন করা হবে।’

এই খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, রাঙ্গামাটি পর্যটন শহর হলেও সরকারি উদ্যোগে পর্যটকদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা গড়ে ওঠেনি। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে এখানে পর্যটনের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। একসময় পর্যটকরা রাঙ্গামাটি বেড়াতে এসে হোটেলে থেকেছেন। এখন এখানে দ্বীপকেন্দ্রিক কটেজ গড়ে উঠেছে। কয়েক বছর ধরে যুক্ত হয়েছে হাউজবোট। সরকার এসব খাত থেকে রাজস্ব পাচ্ছে। পর্যটকরা শতভাগ নিরাপদে এসব হাউজবোটে ঘুরে বেড়ান এবং রাত্রিযাপন করতে পারেন। এই খাতে দুই শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বোটচালক, শেফ, ওয়েটারসহ প্রতিটি হউজবোটে ৮-১০ জন করে ব্যক্তি কর্মরত। পরিবেশ স্থিতিশীল থাকলে এই খাতে আরও বিনিয়োগ হবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
লুসাই দ্য ওয়াটার ভিলার ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এখানে দুই বছর ধরে কাজ করছি। আমিসহ এখানে বোটচালক, শেফ, কিচেন হেলপার, সার্ভিসম্যানসহ মোট ছয়জন কর্মরত। এখানে আমরা আনন্দ নিয়ে কাজ করি। পর্যটকদের চাহিদামতো সেবা দিতে পেরে আমরা খুশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পর্যটকদের কাছে দিন দিন হাউজবোটের চাহিদা বেড়ে চলেছে। ভবিষ্যতে এখানে আরও হাউজবোটের প্রয়োজন হবে। হাউজবোট বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে।’

দ্য রয়েল অ্যাডভেঞ্চার লাক্সারি হাউজবোটের পরিচালক ও হাউজবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম মিজান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাউজবোট রাঙ্গামাটির পর্যটন শিল্পে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। রাঙ্গামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে হাউজবোট। দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের রাঙ্গামাটি ভ্রমণ সহজ করলে পর্যটন ব্যবসায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।’
হাউজবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাপ্পী তঞ্চঙ্গ্যা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাপ্তাই হ্রদে বর্তমানে ১৫টি হাউজবোট রয়েছে। আমরা পর্যটকদের কাছ থেকে দারুণ সাড়া পাচ্ছি। খুব শিগগির আরও কয়েকটি বোট নামবে কাপ্তাই হ্রদে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাঙ্গামাটির পর্যটনের বিকাশে হাউজবোট ভালো ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে তদারকি করার কোনো কর্তৃপক্ষ নেই এখানে। ম্যানেজমেন্টের অভাব রয়েছে। এখানকার পর্যটন খাত ন্যস্ত জেলা পরিষদের কাছে। আর কাপ্তাই হ্রদের মালিক জেলা প্রশাসন। তদারকি ও সহযোগিতা পেলে এই খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
এসআর/এএসএম