ফরিদপুরে এক মাসে ৮ হত্যাকাণ্ড
ফরিদপুরে গত ২০ নভেম্বর থেকে চলতি মাসের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় এক মাসে আটটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে শিশু-নারীও রয়েছে। আটটির মধ্যে মাত্র একটির রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া মাত্র দুটি ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে ও আলোচিত একটি শিশু খুনের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আলোচিত শিশু জায়ান হত্যাকাণ্ড:
গত ২০ নভেম্বর আলফাডাঙ্গা উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের গ্রীস প্রবাসী পলাশ মোল্যার সাত বছর বয়সি শিশুপুত্র জায়ান মোল্যার মরদেহ বাড়ির পাশের একটি বাগান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় শিশুটির মুখে আঘাতের চিহ্ন ও ঝুলন্ত অবস্থায় তার পরনের প্যান্ট দিয়ে মুখমণ্ডল ঢাকা ছিল। ঘটনার পর জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে পাঁচ দফায় মানববন্ধন করেন স্থানীয়রা। এ ঘটনায় শিশুটির মা সিনথিয়া বেগম অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
পুলিশ জানায়, ঘটনার পর ২৫ নভেম্বর প্রতিবেশী ইউনুচ মোল্যা (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক(এসআই) সুজন বিশ্বাস জানান, গ্রেফতার আসামির ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করলে গত ১০ ডিসেম্বর ফরিদপুর ৯ নম্বর আমলি আদালতের বিচারক আনারুল আসিফ এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তবে এ খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন সম্পর্কে জানাতে পারেনি পুলিশ।
ডাব ব্যবসায়ীর মরদেহ উদ্ধার:
গত ২২ নভেম্বর মাজকান্দি-ভাটিয়াপাড়া আঞ্চলিক মহাসড়কের বোয়ালমারী উপজেলার চতুল ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর এলাকার একটি ব্রিজের পাশে ইব্রাহিম (৩৫) নামে এক ডাব ব্যবসায়ীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গোয়ালমারী ইউনিয়নের উত্তরটিলি গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে। এ ঘটনার পরেরদিন নিহতের ভাই ফরহাদ হোসেন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। তবে গত একমাস পেরিয়ে গেলেও এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য মেলেনি।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে যুবক নিহত:
গত ২৩ নভেম্বর নগরকান্দা উপজেলার রামনগরে গভীর রাতে চোর সন্দেহে এলাকাবাসীর গণপিটুনিতে শাহীন শিকদার (২৮) নামে এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরও তিন যুবক। উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের দেবীনগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে এবং নিহতের বাড়ি পার্শ্ববর্তী গজগাহ গ্রামের মোস্তফা শিকদারের ছেলে।
এ ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন নিহতের মা রিক্তা বেগম। তবে ঘটনার একমাসেও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক(এসআই) ইরানুল ইসলাম জানান।

মাছ ব্যবসায়ী নিহত:
গত ৪ ডিসেম্বর দিনগত গভীর রাতের দিকে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর মাছের আড়তে যাওয়ার পথে সালথার কালীতলা ব্রিজ (মাটিয়াদহ) এলাকায় উৎপল সরকার (৩৮) নামে এক মাছ ব্যবসায়ী নিহত হন। এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনার পরেরদিন নিহতের বাবা শহরতলির কানাইপুর ইউনিয়নের রনকাইল গ্রামের অজয় বিশ্বাস হত্যা মামলা করেন।
ঘটনার দিন দুর্বৃত্তদের ব্যবহৃত ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালক রাজন মোল্যাকে (৩০) সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হয়। তিনি নিহতের পার্শ্ববর্তী তেতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার দেওয়া তথ্যমতে গত ১৩ ডিসেম্বর একই গ্রামের ফিরোজ মাতুব্বর (৪৫) ও ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সাভার থেকে জাফর মাতুব্বরকে (৪২) গ্রেফতার করে র্যাব। আসামিরা পূর্ব শত্রুতা ও পরকীয়ার জেরে উৎপল সরকারকে হত্যা করে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন সালথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বাবলুর রহমান খান। তিনি বলেন, নিহত উৎপলের সঙ্গে এক আসামির স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক ছিল, সেই জেরে তাকে হত্যা করে। ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

যৌনপল্লীতে বিছানায় পড়েছিল নারীর মরদেহ:
গত ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে ফরিদপুর শহরের রথখোলা যৌনপল্লী থেকে নাসরিন (৫০) নামে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. আজমীর হোসেন ওই নারীর মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। নাসরিন খুলনার তেরোখাদার পাচুরিয়া এলাকার মো. মজিদ ফরাজির মেয়ে বলে জানা যায়।
পুলিশ ও যৌনপল্লী সূত্রে জানা যায়, ১৩ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে নাসরিন যৌনপল্লীতে তার ভাড়া ঘরে ঘুমাতে যায়। এরপর তার সাড়াশব্দ না পেয়ে প্রতিবেশীরা তার ঘরে ঢুকে তার বিছানায় তার মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশ খবর দেয়। পরে পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
কলাবাগান থেকে রিকশাচালকের মরদেহ উদ্ধার:
গত ১৮ ডিসেম্বর সকালে ফরিদপুর কোতোয়ালী থানাধীন ঈশাণগোপালপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের একটি কলাবাগান থেকে টিপু সুলতান (৪১) নামে এক রিকশাচালকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দুর্বৃত্তরা তাকে গলাকেটে হত্যার পর ব্যবহৃত রিকশাটি নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় নিহতের ভাই সিদ্দিক শেখ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক হিরামন বিশ্বাস বলেন, এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে ও তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
নারীর হাত বাঁধা বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার:
গত ১৯ ডিসেম্বর দুপুরে সদরপুর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সংলগ্ন সড়কের ঢাল থেকে অজ্ঞাত এক নারীর হাত বাঁধা বিবস্ত্র মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা। পরে ৯৯৯-এ কল পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় রাতেই পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে মরদেহটির পরিচয় শনাক্ত করে বলে নিশ্চিত করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আসাদুজ্জামান রিপন। মরদেহটি বোয়ালমারী উপজেলার সোতাশী গ্রামের বারিক শেখের মেয়ে রুমা বেগমের (২৫)।

এ ঘটনায় পরদিন সকালে মৃতের স্বামী তুহিন মণ্ডল বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, এই নারী মানসিক ভারসাম্য ছিলেন এবং মাঝে মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেন। সর্বশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ ছিলেন। হত্যাকাণ্ডটি কীভাবে ঘটেছে তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে জানা যাবে, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে কি-না সে বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ছোট ভাইয়ের বৌয়ের বটির কোপে ভাশুর নিহত:
গত ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভাঙা উপজেলার আলগী ইউনিয়নের গুনপালদী গ্রামে টুকু মোল্লা (৪৬) নামে এক ব্যক্তিকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে সীমা বেগম নামে এক নারীর বিরুদ্ধে। সীমা বেগম নিহতের চাচাতো ভাই তুরস্ক প্রবাসী সোহাগ মোল্লার স্ত্রী। ঘটনার পর তিনি পালিয়ে যান। এ ঘটনায় শনিবার (২০ ডিসেম্বর) নিহতের স্ত্রী আমেনা আক্তার থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন বলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলিমুজ্জামান জানান। তিনি বলেন, অভিযোগ পেয়েছি, মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন ও সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. শামছুল আজম বলেন, সাতটি ঘটনার মধ্যে আমরা সালথার একটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ জড়িতদের গ্রেফতার করেছি, আলফাডাঙ্গায় শিশু হত্যার ঘটনা গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। আমরা আশাবাদী খুব দ্রুত এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনসহ জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে পুলিশ গুরুত্ব সহকারে কাজ করছে।
এন কে বি নয়ন/এমএন/জেআইএম