ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

‘বাড়ির কথা মনে পড়লে বুক ধড়ফড় করে, শুধু কান্দন আসে’

নিজস্ব প্রতিবেদক | বগুড়া | প্রকাশিত: ০৩:৪৩ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

বগুড়ার সোনাভান বয়স্ক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে চুপচাপ বসে ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বেলিচা খাতুন। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ধরা গলায় বললেন, ‘বাড়ির কথা মনে হলে খুব চিন্তা ধরে, বুক ধড়ফড় করে, খালি কান্দন আসে।’

বেলিচা খাতুনের গল্পটা এ দেশের আরও অনেক প্রবীণের মতোই। দুই ছেলেকে বড় করতে জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়েছিলেন। এক ছেলে গাড়িচালক, অন্যজন চাতাল শ্রমিক। ছেলেরা মাকে ভালোবাসলেও সংসারে বাধা হয়ে দাঁড়ান পুত্রবধূরা। প্রতিদিনের ঝগড়া আর গালিগালাজ সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জেদ করেই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন তিনি।

এখানে এসেও নিঃসঙ্গতা কাটেনি। বেলিচা খাতুন জানান, নাতি-নাতনিরা এখন আর খোঁজ নেয় না। বয়স্ক ভাতার টাকাটাও ঠিকমতো হাতে পান না। নিজের মোবাইল না থাকায় টাকা চলে যায় নাতির কাছে। তবুও সন্তানদের প্রতি তার কোনো অভিযোগ নেই। কেউ মাঝেমধ্যে দেখা করতে এলে তিনি শুধু কাঁদেন। তার শেষ ইচ্ছা, একবার বাড়ি ফিরে যাওয়া। বেলিচা খাতুন বলেন, ‘মরার পর ছেলেরা চাইলে মরদেহ নিয়ে যাবে, না চাইলে এই বৃদ্ধাশ্রমেই যা হওয়ার হবে।’

‘বাড়ির কথা মনে পড়লে বুক ধড়ফড় করে, শুধু কান্দন আসে’

আরও পড়ুন:
বৃদ্ধাশ্রমই কী প্রবীণদের আসল ঠিকানা?
বৃদ্ধাশ্রম থেকে ছেলের কাছে বাবার শেষ চিঠি
ম্যাজিস্ট্রেট বউয়ের জ্বালায় মাকে রেললাইনে ফেলে গেলেন ছেলে

একই কেন্দ্রে দেখা হলো বাদশা মিয়ার সঙ্গে। তিন ছেলে-মেয়ে থাকার পরও সাত বছর ধরে তার ঠিকানা এই বৃদ্ধাশ্রম। একসময় শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেছিলেন, এখন ভরসা কেবল চাকাওয়ালা একটি ওয়াকার। ছেলের বউদের লাঞ্ছনা সইতে না পেরে ঘর ছেড়েছিলেন তিনিও। অথচ সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা কমেনি একটুও। নিজের বয়স্ক ভাতার যৎসামান্য টাকা থেকে এখনো কিছু অংশ পাঠান ছেলের কাছে।

শিক্ষকতা ও চাকরি করে জীবন পার করা মোকবুল হোসেনের গল্পটি আরও করুণ। কর্মক্ষমতা হারানোর পর নিজ পরিবারেই তিনি ‘অবাঞ্ছিত’ হয়ে পড়েন। বড় ছেলে প্রবাসে থাকেন, ছোট ছেলে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। স্ত্রী ও নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে থাকার পরও তার ঠাঁই হয়নি ঘরে। শেষ বয়সে এসে আশ্রয় হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়ালে।

বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) জানতে চাইলে সোনাভান বয়স্ক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কেয়ারটেকাররা বলেন, তারা সাধ্যমতো এই প্রবীণদের আগলে রাখার চেষ্টা করেন। ভালোবাসা ও যত্ন দিয়ে সন্তানদের অভাব পূরণ করার চেষ্টা চালানো হয়।

‘বাড়ির কথা মনে পড়লে বুক ধড়ফড় করে, শুধু কান্দন আসে’

সামাজিক সংগঠন ‘মুক্ততারা সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাফিউর রহমান বলেন, ‘আমরা চাই না আর কোনো মা-বাবার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম হোক।’

এদিকে চোখধাঁধানো উন্নয়ন আর আধুনিক শিক্ষার প্রসারের মধ্যেও পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যাওয়াকে উদ্বেগের চোখে দেখছে সচেতন মহল। সরকারি আজিজুল হক কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শফি মাহমুদ বলেন, যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হওয়ার প্রবণতা আমাদের প্রবীণদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। যে মা-বাবা আমাদের পৃথিবীতে এনেছেন, তাদের প্রতি এই উদাসীনতা কোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ হতে পারে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু উচ্চশিক্ষিত হওয়া মানেই মানুষ হওয়া নয়। যাদের হাত ধরে সন্তানরা বড় হয়েছে, বার্ধক্যে সেই বাবা-মায়েরা যেন পরিবারে সম্মান ও ভালোবাসার সঙ্গে থাকতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।

এমএন/এমএস