যেভাবে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেন মাস্টার দেলু
নারায়ণগঞ্জে র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে মারা যাওয়া আলোচিত সন্ত্রাসী ডাকাত দেলোয়ার হোসেন ওরফে মাস্টার দেলু (৩৯) কীভাবে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছেন তা অনেকেরই অজানা। উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মাস্টার দেলু নিহত হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
জানা যায়, গরিব ঘরের সন্তান হওয়ায় অল্প বয়সে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন দেলোয়ার হোসেন। এলাকার বড় ভাইদের কথামতো ফেনসিডিল কিনতে গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন দেলোয়ার।
দু-এক বোতল ফেনসিডিল বিক্রি শুরু করে ধীরে ধীরে বড় মাদক ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ জগতে পা বাড়ান দেলোয়ার। নিজেই একটি বাহিনী গড়ে তুলে ফাইভস্টার গ্রুপ নাম দেয়ায় তার নাম হয় মাস্টার দেলু।
মাস্টার দেলু দেশের বিভিন্ন জেলার মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে গিয়ে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সঙ্গে সম্পর্ক হয়। এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। পরে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি করে আলোচনায় আসেন মাস্টার দেলু। ডাকাতির ঘটনায় একাধিকবার বিভিন্ন থানায় গ্রেফতারও হন। ধীরে ধীরে নাম ছড়িয়ে পড়ে মাস্টার দেলুর। একপর্যায়ে তিনি নিজেকে আরো প্রতিষ্ঠা করতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে জড়িত হন এবং তাদের আশ্রয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালান। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক করে অপরাধের রাজ্য গড়ে তোলেন মাস্টার দেলু।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯০ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে মুন্সিগঞ্জ থেকে সপরিবারে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন দেলোয়ার হোসেন দেলু। তার বাবা জমির বেপারি ছিল একজন ছাগল ব্যবসায়ী। তিনি মুন্সিগঞ্জ থেকে ছাগল কেনে নারায়ণগঞ্জে বিক্রি করতেন। তাদের আদি নিবাস ছিল মুন্সিগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানার আলদী গ্রামে। মুন্সিগঞ্জ ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ আসার পর তারা প্রথমে চাঁদমারি বস্তিতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে চলে যান তল্লায়। এরই মধ্যে দেলু খানপুর বার একাডেমি স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ না থাকায় বেশি দূর এগোয়নি তার লেখাপড়া। পরে একটি গার্মেন্টে কাজ শুরু করে। তখন মা সখিনা বেগম বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন।
গার্মেন্টে কাজের পাশাপাশি এলাকার বড় ভাইদের নানা কাজ করে দেওয়ার কারণে প্রায় দেলু তার বড় ভাইদের জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে ফেনসিডিল, মদ, গাঁজাসহ নানা প্রকার মাদকজাত দ্রব্য নিয়ে আনার কাজটি করতো। এভাবে এক সময়ে জেলার অনেক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে দেলুর। একপর্যায়ে দেলু জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ফেনসিডিল এনে শহরের খানপুর রেললাইন এলাকাতে বিক্রি করতো। মাদক আনার পাশাপাশি দেলুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে বেশ কয়েকজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর।
১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর দেলু চলে যান নুরুল আমিন মাকছুদের অন্যতম ক্যাডার খানপুরের আফজাল ব্লকে। এর আগে তিনি বেশ কিছুদিন খানপুরের ছাত্রদল নেতা মৃত জিল্লুর রহমান ভুলুর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। আফজালের নিয়ন্ত্রণে থাকা সময়ে দেলু সদর থানার দক্ষিণাঞ্চলের খানপুর, ব্যাংক কলোনি, হাজীগঞ্জ, ডনচেম্বার, তল্লা, পাঠানটুলী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন।
ওই সময় দেলু তল্লা এলাকার বেশ কয়েকজন বেকার যুবককে নিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল বাহিনী। আর এই বাহিনীকে নিয়মিত ডাকাতির প্রশিক্ষণ দিতেন দেলু। দেলু তার বাহিনীর নাম দেয় ফাইভস্টার। সেই ফাইস্টারের মাস্টার বনে যান দেলু। বাহিনী চালাতে বিশাল টাকার জোগান দেয়ার জন্য দেলু নিজেই নেতৃত্ব দিয়ে শুরু করেন ডাকাতি।
২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেলুর পরিবার তল্লা ছেড়ে নগর খানপুর মসজিদ সংলগ্ন লিটনের বাড়িতে ভাড়ায় উঠেন। এই বাড়িতে বসেই দেলু বিয়ে করেন। বিএনপির সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার মদদদাতা আফজাল এলাকা ত্যাগ করলে দেলু চলে যান নগর খানপুর এলাকার এক ছাত্রদল নেতার নিয়ন্ত্রণে। এরই মধ্যে তিনি খানপুর এলাকার আঃ কাদির মিয়ার ছেলে খোকনের সঙ্গে সুম্পর্ক গড়ে তোলেন।
মাদক ব্যবসার ভাগ ভাটোয়ার নিয়েই দেলু নগর খানপুর এলাকার মামুন ও খানপুর সরদার পাড়াতে দেলু নামে একজনকে হত্যা করেন। ইতোমধ্যে খোকনসহ অন্যরা কুমিল্লাতে নিহত হয়েছেন। পরবর্তীতে ২০০৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ডিবি পুলিশ বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেলুকে গ্রেফতার করে। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতায় ফের ছাড়া পেয়ে যান মাস্টার দেলু। শুরু করেন আবারো ডাকাতি। জেলার যেখানে তিনি যা করতেন তার কোন বিপদ দেখা দিলেই নগর খানপুরের সেই ছাত্রদল নেতা তাকে সহযোগিতা করতেন।
সম্প্রতি মাস্টার দেলু খানপুর, তল্লা, পাঠানটলীসহ আশে পাশের এলাকাগুলোতে যখন মাদক ব্যবসার প্রভাব বিস্তার শুরু করে তখন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে একাধিকবার অভিযান চালায়। ডিবি পুলিশের সঙ্গে চলতি বছরের ১ অক্টোবর গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় দেলু বাহিনীর গুলিতে ডিবি পুলিশের এসআই মনির হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়।
গোলাগুলির আগের রাতে দেলুর স্ত্রীসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে ২২ অক্টোবর মাস্টার দেলুকে গ্রেফতার করতে গিয়ে ফের ডিবি পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ৩০ মিনিট গোলাগুলি হলেও মাস্টার দেলুকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ সময় একজন এসআই গুরুতর আহত হয়। তবে তার বাহিনীর অন্যতম সদস্য আনিছকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটি বিদেশি পিস্তল ও ইয়াবাসহ উদ্ধার করা হয়।
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সন্ত্রাসী ও ডাকাত সরদার দেলোয়ার হোসেন দেলু ওরফে মাস্টার দেলুর (৩৯) সঙ্গে শনিবার রাত ২টার দিকে (৩০ অক্টোবর) সিদ্ধিরগঞ্জের পাঠানটুলী এসও রোড এলাকাতে র্যাবের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক, অস্ত্র ও ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাব-১১ এর সিপিসি-১ এর কমান্ডার এএসপি শিবলী সাদিক জানান, দেলোয়ার হোসেন দেলুকে আটকের পর পাঠানটুলী এলাকাতে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করতে গেলে র্যাবের উপর গুলি ছুড়ে ও হামলা করে তার বাহিনীর লোকজন। এ সময় র্যাবও পাল্টা গুলি করলে দুইপক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় দেলুকে গুলিবিদ্ধ আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঘটনাস্থল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নাজমুল হাসান বিপুল বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, গুলিতেই দেলুর মৃত্যু হয়েছে। তবে শরীরে কয়টা গুলি আছে, সেটা ময়নাতদন্তের পর বলা যাবে।
মো. শাহাদাত হোসেন/এএম/পিআর