ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

সিলেটে ইংরেজি আর বানান ভুলের ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৪:০৪ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

এখন চলছে ফেব্রুয়ারি মাস। ফেব্রুয়ারি মানেই বাঙালির ভাষা জয়ের দিন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন। সালাম, রফিক, শফিউর, জব্বার, বরকতসহ অনেক শহিদের রক্ত বাংলার উপর উর্দুর আধিপত্যের বিপক্ষে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি এনে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে সবার মাতৃভাষার মর্যাদা। যে জাতির ইতিহাসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন্ম হয়েছে সে জাতির অভ্যন্তরে সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

উর্দু হটিয়ে ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পার হলেও ইংরেজি ভাষার আধিপত্য ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের মাতৃভাষার চেতনা দেখা দেয়, অথচ বছর জুরে চলে ভিন্ন ভাষার উৎসব। সেই দৃশ্য দেখা পড়েছে সিলেটের অলিতে-গলিতে।

সিলেট নগরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামফলক লেখা রয়েছে ইংরেজিতে। বাংলাভাষা এখনও অনেক ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার। এতে বাংলা ভাষার প্রতি স্পষ্ট অবহেলা ও উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে।

দেখে মনে হয় নগরজুড়ে সর্বত্রই এখন বিদেশি ভাষা ব্যবহারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বড় শপিং মল থেকে মুদি দোকানগুলোর বেশিরভাগেরই নামে আছে ইংরেজি ভাষার ছড়াছড়ি।

ইংরেজি সাইনবোর্ড ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলা লেখায় দেখা যায় অসংখ্য ভুল বাংলার ব্যবহার। যেমন- লাইব্রেরী, কোম্পানী, ইন্ডাষ্ট্রি, রেষ্টুরেন্ট, ফার্মেসী, ইন্সটিটিউট, সরকারী, ষ্টেশনারী, অনুষ্টান ইত্যাদি। যার শুদ্ধ বানান লাইব্রেরি, কোম্পানি, ইন্ডাস্ট্রি, রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি, ইনস্টিটিউট, সরকারি, স্টেশনারি, অনুষ্ঠান।

আবার ভাষার মাসে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ না লিখে ভুল বানানে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ লেখা হয়।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালেই দেখা যায়, বিদেশি ভাষায় লেখা নামফলক, বিলবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার, সাইনবোর্ড, তোরণ ইত্যাদি।

এগুলো দেখে বুঝার কোনো উপায় নেই, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের রয়েছে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম আর তাজা রক্ত ঢেলে প্রাণ উৎসর্গ করার ইতিহাস।

সিলেট নগরের জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, নয়াসড়ক, লামাবাজার, মিরাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিদেশি ভাষার চাপে বাংলা ভাষার করুণ পরিণতি। বিশেষ করে শপিংমল, বিপণীবিতানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড- বিলবোর্ডগুলো দেখে মনে হয় যেন, বাংলাদেশের বাইরে কোথাও এগুলোর অবস্থান। যেখানে বিদেশি ভাষার দৌরাত্ম্যে বাংলা খোঁজে পাওয়া অসম্ভব।

প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল ফটকে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে প্রতিষ্ঠানের নাম। বাংলার কোনো অস্তিত্বই নেই। আবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির পাশে বাংলা থাকলেও খুবই ছোট করে লেখা রয়েছে বাংলা।

তবে একেবারেই শুধু ইংরেজিতে লেখা রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, ডিসপ্লে, সিগনাল, টেন পয়েন্ট, প্লাস পয়েন্ট, থাই ফ্যাশন, রয়্যাল সেফ, মা ফ্যাশন, উইস আপ, নাদিয়া ফ্যাশন, ওয়াটার মেভেন আগস্ট, বিসমিল্লাহ ফুড, অটো ট্রেডিং, সিলেট স্টুডিও টুথাউসেন্ড, মা ভেরাইটিজ স্টোর, এস.বি ফার্নিচার, রটাল হেয়ার ড্রেসার, জালালাবাদ ফার্নিচার, পারট্রেক্স ফার্নিচার, ব্রার্দাস ফার্নিচার, ফোর হ্যান্ড, উত্তরা মটরস, আরপেল আপক্রেল, সাইকেল রিপাবলিক, স্টাইল রিপাবলিক, ব্যাঙ, রিভারসি, ড্রেস ফ্যাশন, টপ বেবি, ভনডাচ, সিগনাল, ইমেজ, ফেমাস, হেডলাইন, জেক অ্যান্ড জেন্টস, আইকন, অপশন, ব্রান্ড গ্যালারি, ব্লাক সিল, লেডিস পয়েন্ট, ওয়ান টু হান্ড্রেড, লেডি গাম, এয়ার কন্ডিশন, আক্তার, মেডলাইন, ইউনিক প্লাস, এলিট, হাতিল ডোর, ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ফার্নিচার, রাজা মেটাল, অনুপম রেস্টুরেন্ট, মাহা, ডিজাইনার, স্মার্ট রোল, বেস্ট সুজ, টপ টেন, বেবি সপ, জেনিয়াস, স্টেপ, ফেবুলাস ইত্যাদি।

sylhetnews

১৯৪৮ সালের ৮ মার্চ সিলেটে ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত গোবিন্দ পার্ক বর্তমান হাসান মার্কেটেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডও রয়েছে ইংরেজিতে। যেমন- জনি ব্রাদার্স, বাপ্পি ফ্যাশন, স্টাইল হাউস প্রভৃতি।

অথচ এখানে মাতৃভাষা বাংলার জন্য আহত ও নির্যাতিত হয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন ফেঞ্চুগঞ্জের মকসুদ আহমদ ও কমরেড পীর হাবিবুর রহমান, দেওয়ান আজররফসহ অনেকে।

সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ট্রেডলাইসেন্সে বাংলায় সাইনবোর্ড থাকার কথা উল্লেখ থাকে। তবুও যারা এই নিয়ম অমান্য করে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার করছেন সেই সকল প্রতিষ্ঠানকে নজরে আনা হবে।

এ ব্যপারে সিসিকের প্রধান নির্বাহী এনামুল হাবিবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি।

বাংলা ব্যবহারের এই করুণ দশা সম্পর্কে ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আশরাফ হোসেন বলেন, বহু কষ্টে অর্জিত আমাদের এই মাতৃভাষা বাংলা। ভাষার জন্য আমরা রাজপথে সভা-সমাবেশ, মিছিলসহ আন্দোলন করেছি। কিন্তু আজ এই ভাষার প্রতি অমর্যাদা ও অবহেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ভাষা আন্দোলনের সময় নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া তরুণ এখন ৮৪ বছরে এসে মনে করেন, যে ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঝরাতে হয়েছে। সে ভাষার জন্য সকলেই মানবিক দিক থেকে দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ খুবই প্রয়োজন।   

চলতি ভাষার মাসে সিলেটে বেশ কয়েকটি সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার অনেকটিতে ব্যানারসহ প্রায় সব কিছুতে ছিল ইংরেজি ব্যবহার।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি নগরের দরগা গেইটস্থ একটি হোটেলে ধ্রুবতারা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ইয়ুথ পার্লামেন্ট অধিবেশনের ব্যানারসহ সব কিছু ছিল ইংরেজিতে।

অথচ এই সংগঠনের সঙ্গে কোনো বিদেশি সংস্থা জড়িত নয় বলে তাদের দাবি। এমনকি বিদেশি কোনো অতিথিও ছিলেন না এ অনুষ্ঠানে।

এ ব্যাপারে ধ্রুবতারা সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে হয়েছে। তাছাড়া প্রতিবছরই এ অনুষ্ঠানে সংগঠনের ব্যানার ইংরেজিতে লেখা থাকে।

অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ বলে উল্লেখ রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, সংবিধানে বাংলা ও ইংরেজি উভয় পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে প্রাধান্য পাবে বাংলা পাঠ।

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বাংলায় একটি মামলার রায় দেয়। ২০১৩ সালে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে বাংলার প্রচলন, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, গাড়ির নম্বর প্লেট, ব্যানার, বিভিন্ন দফতরের নামফলক, গণমাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

এরপর একই বছরের ১৪ মে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলায় লেখা নিশ্চিত করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দেয়।

ছামির মাহমুদ/এএম/জেআইএম