ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

পেশা বদলালেও যত্নে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর মাটি কাটার কোদালটি

আমিন ইসলাম জুয়েল | প্রকাশিত: ০১:৫৯ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২১

‘হুনছিলাম বঙ্গবন্ধু সোনার কুদাল দ্যা মাটি কাইটে সোনার ডালিত তুইলে বাঁধ বানানো হুরু করছিল। পরে হুনি সোনার কুদাল না সাধারণ কুদাল দ্যা মাটি কাটিছিল বঙ্গবন্ধু।’

কথাগুলো বলছিলেন পাবনার বেড়া উপজেলার চরকান্দি গ্রামের গৃহবধূ রহিমা খাতুন। তার মতো পাবনায় পাড়া গাঁয়ে অনেক মানুষের মনে ধারণা ছিল- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সোনার কোদাল’ দিয়ে মাটি কেটে ঐতিহাসিক ‘মুজিব বাঁধ’র উদ্বোধন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু নগরবাড়ী এলাকায় একটি সাধারণ কোদাল দিয়ে মাটি কেটে বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু সেখানে সাধারণ এক তরুণ মেটেল (মাটি কাটা শ্রমিক) আব্দুল লতিফ শেখের (বর্তমান বয়স-৭১) কোদাল ও একটি ডালি (ঝুড়ি) নিয়েছিলেন। ডালিটি কেউ যত্ন করে না রাখলেও আব্দুল লতিফ শেখ তার কোদালটি গত চার যুগ ধরে সযত্নে রেখে দিয়েছেন। তিনি এ ঐতিহাসিক কোদালটি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেই তুলে দিতে চান।

সম্প্রতি কয়েকজন প্রবীণের মাধ্যমে সেই কোদালের গল্প শুনে আব্দুল লতিফ শেখকে খুঁজে বের করে জাগো নিউজ। লতিফ শেখ পাবনার বেড়া উপজেলার চরকান্দি গ্রামের মৃত আ. রহমান শেখের ছেলে। তাদের তিন ভাই ও এক বোনের খাবার জোটাতে তার মা-বাবার অনেক কষ্ট হত। দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই তিনি তার বাবার কথামতো মাটি কাটার কাজ শুরু করেন। যাকে পাবনার ভাষায় মেটেল বা ম্যাটেল বলে।

jagonews24

তখনকার সময় সর্দারের অধীনে মাটির কাটার কাজ করতে হত। তার সর্দার ছিলেন হামেদ (আ. হামিদ) সর্দার। তিনি এখন বেঁচে নেই। তার সঙ্গে তিনি নগরবাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে থাকার জন্য আর পাক হানাদার বাহিনীকে আটকে ফেলার জন্য গর্ত (বাঙ্কার) খোঁড়ার কাজও করেছেন।

লতিফ শেখ জানান, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের দিকে তিনি তখন ১৮-১৯ বছরের টগবগে তরুণ, অবিবাহিত ছিলেন। কর্মস্থলে তার জ্যেষ্ঠ হামেদ সর্দার একদিন তাকে বলেন, নগরবাড়ীর কাছে বসন্তপুরের আন্ডেলের জোলার (খাল) কাছে যেতে হবে কাজে। বাঁধের কাজ হবে। বাঁধ উদ্বোধন করবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে এসে।

তিনি আরও জানান, শেখ সাহেবের (বঙ্গবন্ধু) কথা শুনলে মানুষ বানের পানির মত চলে আসত। বাঁধের মাটি কাটলে দিনে চার-পাঁচ কেজি গম পাওয়া যাবে আবার বঙ্গবন্ধুকেও দেখা যাবে। তাই তিনি সময়মত সেখানে হাজির হন।

বঙ্গবন্ধুর আসার সঠিক তারিখ তার মনে নেই আব্দুল লতিফ শেখের। কারণ ইংরেজি তারিখ তিনি বুঝতেন না। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টার থেকে নামলেন তার চোখের সামনেই। সে সময় হেলিকপ্টারের পাখার (ঝড়ের মতো) বাতাসের কথা তার আজও মনে আছে। বঙ্গবন্ধু হেঁটে ঘিরে রাখা একটা জায়গায় তাদের কাছে আসলেন। সেখান থেকে তারা কোদাল নিয়ে আগেই অপেক্ষা করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মাটি কাটার জন্য আলাদা কোনো কোদাল বানিয়ে রাখা ছিল না। তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে কোদাল দেয়ার জন্য একটা কোদাল চাওয়া হয়। আব্দুল লতিফ শেখ তার কোদালটি এগিয়ে দেন বঙ্গবন্ধুকে দেয়ার জন্য। এরপর একটি ডালি দেন কোনো একজন।

তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু নিজে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে বাঁধ উদ্বোধন করেন। এরপর বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভা শেষে তারা বাঁধের জন্য মাটি কাটা শুরু করেন। বেশ কয়েকমাস মাটি কাটেন। বাঁধের কাজ শেষে তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি পেশা বদলান। তবে কোদালটি তিনি বদল করেননি। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির কোদালটি রেখে দেন।

আব্দুল লতিফ শেখের স্ত্রী জুলেখা খাতুন জানান, বিয়ের পর এসেই তিনি কোদালটি তুলে রাখা দেখেন। পরে তিনি জেনেছেন এ কোদাল দিয়ে বঙ্গবন্ধু মাটি কেটে মুজিব বাঁধের কাজ শুরু করেছিলেন। কোদালের প্রতি তার স্বামীর গভীর ভালোবাসা বুঝতে পারেন। তাই তিনি নিজেও কোদালটি যত্ন করেই রেখে দেন।

jagonews24

তিনি আরও জানান, তার স্বামী অনেক আগেই বলেছেন- যদি কোনোদিন দিতে পারি শেখ সাহেবের বেটির (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) হাতেই এটা দিয়ে দেব। না পারলে, আমি মরে গেলেও এ কোদাল কাউকে দিও না।

কোদালের প্রতি ভালোবাসার বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল লতিফ শেখ বলেন, ‘তরুণ বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধুকে আমি ভালোবাসতাম। আর সেই বঙ্গবন্ধু আমার কোদাল দিয়ে মাটি কেটে মুজিব বাঁধ শুরু করেছিলেন। এ কোদালের সঙ্গে মুজিব বাঁধের সম্পর্ক আছে। এটা বিরাট একটা ভাগ্যের ব্যাপার আমার জন্য। তাই আমি এটাকে শেখ সাহেবের হাতের জিনিস বলে মনে করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘুনে খেয়ে কোদালের লাঠিটা নষ্ট হয়ে গেছে। তবে কোদালটি ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও এখনো আছে।’

লতিফ জানান, মাটি কাটা বাদ দেয়ার পর কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এরপর সংসার চালানোর জন্য ৯ বছর তিনি কাঁচামালের ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৮৮-এর বন্যায় ব্যবসা করা অবস্থায় তিনি কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। সে সময়ে তার সামান্য সঞ্চিত টাকাও ফুরিয়ে যায়। তার মায়ের দেয়া দেড়শ টাকা আর শাশুড়ির দেয়া কিছু টাকা দিয়ে তিনি চিকিৎসা করান। সুস্থ হওয়ার পর পুঁজির অভাবে আর কাঁচা তরি-তরকারির ব্যবসা করতে পারেননি। তখন তিনি রুটি-রুজির তাগিদে বাড়ির অদূরে যমুনায় মাছ ধরা শুরু করেন।

দীর্ঘ বছর যমুনায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছেন আব্দুল লতিফ শেখ। এখন বয়সরে ভারে ন্যুব্জ তিনি। বছর দুয়েক হলো তিনি মাছ ধরার কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। যে যমুনায় যৌবনে জীবন যুদ্ধ করেছেন এখন যমুনায় যেতেই ভয় পান। এখন সব কাজ শেষে যেন পরপারে যাওয়ার দিন গুনছেন।

আবদুল লতিফ শেখ এর ছেলে আমিনুল ইসলাম আলম জানান, তারা তার বাবার মুখেই মুজিব বাঁধ উদ্বোধনের কথা শুনেছেন। তিনি ছোট একটি ব্যবসা করে সংসার চালান। বাবা-মাকে দেখাশোনা করেন।

তিনি আরও জানান, তার বাবা কোদালটি কারও কাছে দেন না। তার কথা- এ স্মৃতিটা বঙ্গবন্ধুর মেয়ের কাছে দেবেন। যদি না পারেন, তাহলে তার মৃত্যুর পর এটা বঙ্গবন্ধুর পরিবার ছাড়া কারও কাছে না দেয়ার জন্য বলেন।

jagonews24

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও পাবনা-১ (সাঁথিয়া- বেড়া) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৃহত্তর পাবনা জেলাকে বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য বাঁধটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু এ অঞ্চলের বন্যা মোকাবিলায় একটি বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু নগরবাড়িতে আসেন। তিনিও ওই দিন সেখানে হাজির ছিলেন।

তিনি আরও জানান, বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে মাটি কেটে ১৫৭.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে মানুষ ভালোবেসে ওই বাঁধের নাম দেন ‘মুজিব বাঁধ’। এই বাঁধ নির্মাণ হওয়ার পর থেকেই এটি পাবনা জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণে রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে যাতায়াতের জন্য তৈরি হয়েছে প্রশস্ত সড়ক। এ বাঁধটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। আর সে হিসেবে কোদালটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলের মতো।

শামসুল হক টুকু জানান, বঙ্গবন্ধুর কাজের অনেক দলিল এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। যেমন আব্দুল লতিফ শেখ এতটা বছর বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে তার একটি স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। এটা বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রমাণ। এ ঐতিহাসিক কোদালটি বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে দেখানোর জন্য বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা দরকার।

আমিন ইসলাম/এসজে/এইচএ/এমকেএইচ