ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

পাহাড়ে দুই চাকার বাহনে ভাগ্য বদল

জেলা প্রতিনিধি | খাগড়াছড়ি | প্রকাশিত: ০৯:৩৮ পিএম, ০৬ আগস্ট ২০২১

তখনো সূর্য ওঠেনি। কেউ কেউ ফজরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হলেও বেশির ভাগই যার যার ঘরে ঘুমে। রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী বাসগুলো পাহাড়ের বুক চিরে খাগড়াছড়িতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এ যখন দৃশ্যপট তখন আরামের ঘুমকে হারাম করে রুটি রুজির আশায় দুই চাকার বাহন মোটরসাইকেল নিয়ে পার্বত্য খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে পুলিশ বক্সের সামনে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে ৮-১০ জন যুবক।

বলছিলাম ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালকদের কথা। যাদের এভাবেই প্রতিদিন সকাল শুরু হয়। দুর্গম পাহাড়ে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে সংসার চলে তাদের। যাদের হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ি জনপদে বিকল্প কর্মসংস্থান আর পরিবারে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। গত এক দশকেরও বেশি সময় আগে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়েই এ পেশায় যুক্ত করেছে নিজেদের।

ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অনেকেই স্বল্প সময়ে এ পেশার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য বদল করেছেন। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুই চাকার বাহন মোটরসাইকেল হয়ে উঠেছে পাহাড়ে ভাগ্য বদলের অন্যতম মাধ্যম।

jagonews24

শুধু মাটিরাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধা চত্বরই নয়, ভোরের সূর্য ওঠার পরপরই জালিয়াপাড়া, মানিকছড়ির আমতল, মহামুনী, খাগড়াছড়ি বাস স্টেশন, জিরো মাইল, চেঙ্গী স্কোয়ার, পানছড়ির পুলিশ বক্স মোড়, মহালছড়ি ও গুইমারাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ভাড়ার সন্ধানে জড়ো হতে থাকেন ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালকরা। প্রতিদিনই যারা মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে যাত্রীকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেন।

ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্গম পাহাড়ি জনপদে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের কথা বিবেচনা করে ২০০৭ সালের দিকে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনের কাজ শুরু করে মাটিরাঙ্গার কয়েকজন বেকার যুবক। এরপর গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পাহাড়ের বেকার যুবকদের অন্যতম কর্মক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন।

মোটরসাইকেল চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে যাত্রী বহনের এ পেশাকে ভাগ্য বদলের হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন পাহাড়ের বেকার যুবকেরা। এসব মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক। চড়ামূল্যের চাকরির বাজারে বিকল্প কর্মসংস্থন হিসেবে এ পেশাকে বেছে নিয়েছেন তারা। গত এক যুগে এ পেশায় সফলতাও পেয়েছেন তারা। বেকারত্ব ঘুচিয়ে এ পেশার হাজার হাজার যুবক এখন পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস।

মোটরসাইকেলচালক সুমন, মোহাম্মদ ইয়াছিন, আল আমিন ও আব্দুল জলিল এ প্রতিবেদককে জানান, মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করে তাদের অনেকেই বেকারত্বকে বিদায় জানিয়েছেন। এ পেশায় ভাগ্য বদলের মাধ্যমে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছেন তারা। অনেকেই পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এনেছেন। মোটরসাইকেল চালিয়ে অনেকেই ভাই-বোন বা ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত করেছেন।

এই যুবকেরা জানান, দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে এ পেশা তাদের নতুন জীবনের স্বাদ এনে দিয়েছে। অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁই জরাজীর্ণ ঘরকে নতুন করে দিতে পেরেছে এ পেশার রোজগার। স্ত্রী-সন্তান, পিতামাতা নিয়ে সুখেই আছেন খাগড়াছড়ির ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালকেরা।

jagonews24

মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে ভাগ্য বদলের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে সংসারের বোঝা হয়েছেন। আবার যাত্রীবেশী সন্ত্রাসীদের হাতে জীবনও দিয়েছে অনেক মোটরসাইকেলচালক।

জানা গেছে, পাহাড়ের অধিকাংশ সড়ক দূর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অন্যান্য যানবাহন চলাচল করতে পারে না। সেসব সড়কে প্রতিদিন মোটরসাইকেলচালক যাত্রী বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দেন। পাহাড়ি সড়কে দূরত্ব অনুযায়ী যাত্রীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেন।

এতে তাদের একেক জনের দিনে আয় হয় ৮০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। তেল খরচ বাবদ ব্যয় হয় ১৫০-২০০ টাকা। অবশিষ্ট টাকা দিয়েই চলে তাদের সংসার ও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ।

ব্যবসায়ী মো. আব্দুল মুনাফ বলেন, পাহাড়ি সড়কে দ্রুততম গন্তব্যে পৌঁছাতে অন্যতম বাহন মোটরসাইকেল। রাত-বিরাতেও যে কোনো প্রয়োজনে মোটরসাইকেল চালকদের ফোন দিলেই চলে আসে। পাহাড়ি সড়কে অন্য বাহনের চেয়ে মোটরসাইকেল করে অনায়েশেই রোগী নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারে।

jagonews24

মোটরসাইকেল চালকদের প্রশিক্ষণ ও ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্তি সহজীকরণের দাবি জানিয়ে মাটিরাঙ্গায় ভাড়ায় মোটরসাইকেলচালক সমিতির সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালানোর মাধ্যমে পাহাড়ে শিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত বিশ হাজার বেকার যুবকের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।

মোটরসাইকেল চালকদের সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে মন্তব্য করে মাটিরাঙ্গার ট্রাফিক পরিদর্শক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালকদের অনেকেই অদক্ষ। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনায় অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করছে। তাদের উচিত আইন মেনে সাবধানে ড্রাইভ করা যাতে কোনো প্রকার দুর্ঘটনা না ঘটে।

মাটিরাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বেকারত্ব যখন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন ভাড়ায় মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করে বিকল্প কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে কেউ যদি আইন মেনে এ পেশায় আসেন, তা অবশ্যই ইতিবাচক।

মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এমআরএম/এএসএম