পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্র চা বাগান এখন চাষিদের গলার কাঁটা
ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চা চাষিরা-ছবি জাগো নিউজ
পঞ্চগড় উপজেলা সদরের ধাক্কামারা ইউনিয়নের নলেহাপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র চা চাষী আমিনার রহমান। তিনি অন্য ফসলের জমিতে দুই একর জমিতে চা বাগান করেছেন। সেই বাগানে উৎপাদিত কাঁচাপাতা বিক্রির জন্য ১৫ দিন থেকে বিভিন্ন কারখানায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। চা চাষি আমিনারের মতো পঞ্চগড়ের অধিকাংশ ক্ষুদ্র চা চাষির একই অবস্থা।
আমিনার রহমান জাগো নিউজকে বলেন, নর্থবেঙ্গল চা কারখানায় আমি পাতা দিতাম। তারা আমাকে ১৫ দিন থেকে ঘুরাচ্ছেন। তাদের অনুমতি নিয়ে বাগানে পাতা কাটতে হয়। পরদিন সেই পাতা না নিলে ফেলে দিতে হবে। ১৫ দিন থকে তিনি তারিখ দিচ্ছেন। পাতা উত্তোলনের আগের দিন মোবাইল ধরছেন না। এভাবেই আমার বাগানের পাতা বড় হয়ে যাচ্ছে। কারখানায় সময়মতো পাতা দিতে পারলে আমি মান অনুযায়ী ৪ থেকে ৫ পাতা পর্যন্ত দিতে পারতাম।
মূলত পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্র চা বাগান এখন চা চাষিদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। লাভের গম, ভুট্টা, বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে চা উৎপাদন করে কাঁচা পাতা বিক্রি করতে পারছেন না চাষিরা। আবার দীর্ঘমেয়াদি ফসল হিসেবে তৈরিকৃত আশার চা বাগান কেটে অন্য ফসলেও যেতে পারছেন না। এ নিয়ে স্থানীয় চা চাষিদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।
কারখানা মালিকদের নানামুখী চালবাজির কারণে চা বিক্রি করতে না পেরে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করছেন চাষিরা।
কারখানা মালিক পক্ষের দাবি, ক্ষুদ্র চা চাষিরা নিয়ম মেনে ৪ থেকে সাড়ে ৫ পর্যন্ত চায়ের ডগা না এনে ১০-১২ পাতা পর্যন্ত ডালসহ কেটে আনছেন। এজন্য আমরা সেই চা পাতা নির্ধারিত মূল্যে নিতে পারছি না। পাশাপাশি বেশি পরিমাণে চা পাতা কর্তনের ফলে চাহিদার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি উৎপাদন হওয়ায় কৃষকদের চাহিদামতো চা ক্রয় করা যাচ্ছে না।

বর্তমানে চা কারখানায় সময়মতো চায়ের কাঁচাপাতা দিতে না পেরে চরম বিপাকে পড়েছেন দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল পঞ্চগড়ের ক্ষুদ্র চা চাষি ও বাগান মালিকরা। নির্দিষ্ট সময়ে বাগান থেকে পাতা উত্তোলন করতে না পেরে চা গাছ বড় হয়ে বাগান নষ্ট হচ্ছে। চায়ের এই ভরা মৌসুমের দ্বিতীয় দফায় মূল্য নির্ধারণ কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা পাতা বিক্রি করতে পারছেন চা চাষীরা।
শুক্রবার (৩ জুন) জেলার বিভিন্ন এলাকার চা বাগান ও কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, নির্ধারিত সময়ে চা পাতা উত্তোলন না করায় বাগানের চা গাছ বড় হয়ে যাচ্ছে। অনেকে কারখানায় চা দিতে না পেরে পাতা কেটে ফেলে দিচ্ছেন। মূল্য নির্ধারণ কমিটির ১৮ টাকা কেজি দরে চা বিক্রি করতে না পেরে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চা চাষিরা। বর্তমানে চা পাতা উত্তোলনের ভরা মৌসুমে কাঁচা চা পাতা অর্ধেক দামেও বিক্রি করতে পারছেন না। বিভিন্ন কারখানার সামনে চা নিয়ে ধরনা দিতে দেখা গেছে চা চাষিদের।
স্থানীয় কয়েকটি চা কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন কারখানায় চাহিদার তুলনায় পাতা সরবরাহ বেশি। পাশাপাশি মানসম্পন্ন চা উৎপাদনের পূর্বশর্ত একটি পাতা দুটি কুড়ির পরিবর্তে ৮ থেকে ১০ পাতা পর্যন্ত চা পাতা সরবরাহ করার অভিযোগ চা চাষিদের বিরুদ্ধে।
কারখানা মালিকরা বলছেন, কাঁচা পাতার উৎপাদন এবং সরবরাহ বেশি হওয়ায় কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী পাতা ক্রয় করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি ভালো মানের পাতা সরবরাহ না পাওয়ায় তারা ভালো মানের চা উৎপাদন করতে পারছেন না। এজন্য অকশন মার্কেটে ভালো দাম না পাওয়ায় তারাও চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী মূল্য দিতে পারছেন না।

স্থানীয় চা বোর্ড সূত্র জানায়, জেলায় প্রতিনিয়িত চা চাষের পরিধি বাড়ছে। পাশাপাশি কাঁচা পাতা এবং তৈরিকৃত চা উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। গত উৎপাদন মৌসুমে জেলায় ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮ হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা থেকে ২২টি চা কারখানায় এক কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি তৈরিকৃত (মেড টি) চা উৎপাদন করা হয়েছে। এবার আরও বেশি চা উৎপাদনের আশা করছে স্থানীয় চা বোর্ড।
ধাক্কামারা ইউনিয়নের মিলনবাজার এলাকার ক্ষুদ্র চা চাষি কুদরত এ খোদা মুন জাগো নিউজকে বলেন, চা কারখানা মালিকরা চায়ের উৎপাদন মানসম্মত না হওয়ায় অকশন মার্কেটে ভালো দাম না পাওয়ার দোহাই দিয়ে আমাদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করছেন। কিন্তু তারা সময়মতো না নিলে বাগানে চা পাতা তো বড় হবেই। এখানে চা চাষিদের দোষ কোথায়? তারাই আবার বড় পাতা নিয়ে গেলে অর্ধেক দামে সেই পাতা কিনে নিম্নমানের চা তৈরি করে কম দামে অকশন মার্কেটে চা বিক্রি করছেন।
তিনি আরও বলেন, অকশন মার্কেটে পাওয়া দাম অনুযায়ী চা বোর্ডের ফর্মুলায় চা পাতার মূল্য নির্ধারণ করছেন। এই ফর্মুলায় চায়ের মান খারাপ হলেও পরিমাণ কিন্তু দ্বিগুণ হচ্ছে এবং তারা কম দাম পেলেও উৎপাদিত পরিমাণের দিক থেকে দামও দ্বিগুণ পাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের চা পাতার মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে অর্ধেক দাম দিচ্ছেন।

মরগেন টি ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী নিয়াজ আলী চিশতী জাগো নিউজকে বলেন, মান ঠিক রেখে চা পাতা সরবরাহ করলে আমরা নির্ধারিত ১৮ টাকা মূল্যেই চা চাষিদের মূল্য পরিশোধ করছি। তবে ভালো মানের চা পাতা সরবরাহের জন্য চা চাষিদের বারবার বলার পরও তারা পাতা বড় করে নিয়ে আসছেন। এই পাতা থেকে মানসম্মত তৈরিকৃত চা উৎপাদন না হওয়ায় অকশন মার্কেটে ভালো দাম পাই না। তাই চা চাষিরাও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এবার চায়ের উৎপাদন বেশি হওয়ায় ক্রয়কৃত কাঁচাপাতা আমাদের কারখানায়ই নষ্ট হচ্ছে। এখানে চায়ের ভালো দাম পেতে হলে ৪ থেকে সাড়ে ৫ পাতা পর্যন্ত চা চাষিদের পাতা সরবরাহ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শামীম আল মামুন জাগো নিউজকে বলেন, পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চল ক্ষুদ্র চা চাষ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। এখানে প্রতিনিয়িত চা চাষের পরিধি বাড়ছে। চা চাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে মূল্য নির্ধারণ কমিটি কাঁচা পাতা কেজি প্রতি ১৮ টাকা মূল্য নির্ধারণ করেছেন।
শর্ত অনুযায়ী চা চাষিরা ৪ থেকে সাড়ে ৫ পাতা পর্যন্ত চা দিলে কারখানা মালিকরা নির্ধারিত মূল্য পরিশোধের কথা। এ নিয়ে চায়ের মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক সজাগ রয়েছেন।
এসএইচএস/জেআইএম