ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

‘কেউ কি নেই আমার ভাঙা ঘরটা মেরামত করে দেবেন’

লিপসন আহমেদ | প্রকাশিত: ১১:৪২ এএম, ১৫ জুলাই ২০২২

‘আপা ঘরে ভাত আছে, (বোন) না ভাই ঘরে কোনো ভাত নাই। আম্মা জুতা সেলাইয়ে কাজ শেষ করে চাল নিয়া আসবে তারপর সবাই ভাত খেতে পারব। (ভাই) আপা তাহলে পানি দে, খিদা লেগেছে। ভাইরে ঘর পানিও নাই।’ ছোট ভাইদের কথাগুলো বলে কাঁদছিল ১০ বছরের শিশু রাজমতি। এটা কোনো গল্প কিংবা সিনেমার কাহিনী নয়, বাস্তব জীবনের।

একপাশে ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে সুরমা নদীর পানি। অন্যপাশে ছোট একটি ভাঙা ঘরে বসে চলছে ভাই-বোনদের নানা কথোপকথন। দেখে বুঝার উপায় নেই তারা যে না খেয়ে আছে। বড় বোন তাদের পেটের খিদার জ্বালা ভুলিয়ে রাখতে শুনাচ্ছে লাল, নীল পরীর গল্প।

jagonews24

বন্যার শুরু হওয়ার পর তিন বেলা পেট ভরে খাবারও জোটেনি তাদের ভাগ্যে। এমনকি একমাত্র আশ্রয়ের ঠিকানা বানের পানিতে ভেঙে যায়। সেই ভাঙা ঘরেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হচ্ছে এ অবুঝ শিশুগুলোকে।

তাদের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের রাজার গাঁও গ্রামে। গ্রামের নামটি শুনে অবাক হলেও প্রকৃতপক্ষে এ গ্রামে কোন রাজা কিংবা বাদশা নেই। যারা বসবাস করেন তারা কেউ দিনমজুর, কেউ কৃষক আবার কেউবা জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন। এদেরই একজন ময়না মতি। পাঁচ বছর আগে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামীকে হারিয়ে চার সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে নিজেই বাজার কিংবা গ্রাম ঘুরে মানুষের জুতা সেলাই করে দেন।

ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ভালোই কাটছিল ময়নামতির সংসার। কিন্তু উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তছনছ হয়ে গেছে তার একমাত্র সম্বল ঘরটি। ভেসে গেছে ঘরের সব আসবাবপত্র। ভেসে গেছে তার অর্থ যোগান দেওয়া জুতা সেলাইয়ের মূল যন্ত্রগুলো। সন্তানদের নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিলেও বন্যার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তিন বেলা খাবার পেটে পড়েনি। এমনকি সরকারি কোনো সহায়তাও পাননি। বর্তমানে বন্যার পানি কমলেও ময়নামতি ঘরটা ভেঙে আছে। সেই ভাঙা ঘরেই ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন তিনি।

jagonews24

জুতা সেলাইয়ের মূল যন্ত্র অন্যের কাছ থেকে ধার করে ছোট তিন ছেলে সন্তানকে পরিবারের বড় মেয়ে রাজমতির কাছে রেখে কাজে বেরিয়ে পড়েন।

ময়নামতি পরিবারের ছোট ছোট সদস্যরা জানায়, ‘বন্যার পর থেকে তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারি না। খুব কষ্টে আছি আমরা, সরকার কী আমাদের দেখে না।’

১০ বছরের শিশু রাজমতি বলেন, ‘আম্মু জুতা সেলাইয়ের কাজে সেই সকালে বাড়ি থেকে গেছেন, রাতে আসবেন। এখনো চার ভাই-বোনের পেটে কোনো খাবার পড়েনি। ছোট ভাইগুলো বলছে তাদের খিদা লেগেছে কিন্তু ঘরে খাবার নেই। তাদের খিদা ভুলিয়ে রাখতে লাল, নীল পরীর গল্প শোনাচ্ছি।’

jagonews24'

ময়নামতি বলেন, ‘বন্যায় ঘরটা ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। এখন ভাঙা ঘরে ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকি। হঠাৎ একদিন খবর পাবেন ঘর ভেঙে আমাদের ওপর পড়ে পরিবারের সবাই মরে গেছি। শুধু দুঃখ একটাই সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা পেলাম না। কেউ কি নেই আমার ভাঙা ঘরটা মেরামত করে দেবেন?’

তিনি আরও বলেন, ‘দুঃখে দুঃখে জীবনটাই গেলো আমার। পাঁচ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছি। তারপর ছেলে-মেয়ের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য কিছুদিন ভিক্ষা করেছি। কিন্তু কেউ ভিক্ষা দেয়নি। বরং বলে কাজ করি না কেন তা জানতে চায়। কিন্তু বড় ধরনের কাজ করার সামর্থ্য আমার নেই। কারণ আমার শরীরে বিভিন্ন রোগের বাসা বেঁধেছে। ছেলে মেয়ের জন্য হয় তো ওপরওয়ালা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখন স্বামীর জুতা সেলাইয়ের কাজ আমি শুরু করি। ভালোই চলছিল। কিন্তু বন্যায় মাথা গোজার ঠাঁইটুকুও ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। সরকার সবাইকে সহযোগিতা করছে কিন্তু আমি পেলাম না।’

jagonews24

স্থানীয় ইউপি সদস্য সালেক মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারের দেওয়া ১০ হাজার টাকা আমার ওয়ার্ডের একজন মানুষও পায়নি। অথচ আমার ওয়ার্ড খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলে আবেদন করতে।’

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্যা পরবর্তী মানুষ যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, এজন্য আমরা সব ধরনের চেষ্টা করেছি।’

লিপসন আহমেদ/এসজে/জিকেএস