লোহাগড়ায় গ্রাম ছাড়ছে এলাকাবাসী : পরীক্ষার্থীরা মামলার আসামি
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কয়েকটি গ্রামের দ্বন্দ্বে মামলার আসামি হয়ে চলমান এসএসসি পরীক্ষা বাদ দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ৫ পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা শুরুর পর মাত্র দুটি পরীক্ষা দিতে পেরেছে তারা। এরপর থেকে সবাই হত্যা ও লুটপাট মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম।
এরা হলো, হিরন মৃধা (১৭)। সে দোয়া মল্লিকপুর গ্রামের হারুন মৃধার ছেলে। হিরন লক্ষ্মীপাশা আদর্শ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল। চরমল্লিকপুর গ্রামের ওহাব শেখের ছেলে সজল শেখ (১৭)। সেও স্থানীয় মঙ্গলহাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিচ্ছিল। দোয়া মল্লিকপুর গ্রামের মন্টু মল্লিকের ছেলে বশির মল্লিক (১৭)। সেও মল্লিকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো। একই ভাবে পরীক্ষা দিতে পারছে না নাজিম শেখ, সাজ্জাদ শেখ।
প্রায় ২০ বছর ধরে এখানকার দুটি গ্রামে হানাহানি চলছে। আর এর ফলে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে, ধ্বংস হচ্ছে বাড়ি-ঘর আর লুটপাট হচ্ছে অন্যের সম্পত্তি। আর লুটপাটের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে নিরীহ বাসিন্দারা। এছাড়াও সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হচ্ছে তা হলো এ এলাকার ছেলেদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মামলা আর হামলার আশঙ্কায়।
সম্প্রতি সরেজমিনে নড়াইলের দাঙ্গা কবলিত মল্লিকপুর ইউনিয়নের দোয়া মল্লিকপুর, চর মল্লিকপুর গ্রাম ঘুরে ভয়ঙ্কর এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দোয়া মল্লিকপুর গ্রামের পুরুষশূন্য মনিরুজ্জামান মল্লিক এর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে গোয়ালঘরে পড়ে আছে ৪টি দুধ খাওয়া বাছুর। আর সেই সব বাছুর জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন তার স্ত্রী মাঝবয়সী শাহিনা বেগম।
তিনি জানালেন গত শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে মারামারি হবার পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে প্রতিপক্ষের ১৫ জন লোক তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়ির সোনা আর টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে যায়। এসময় তার গোয়ালে থাকা ৪টি গাভীসহ মোট ৮টি গরু লুট করে নিয়ে যায় তারা। ভয়ে তিনি কাউকে কিছু না বলতে পেরে পরদিন থেকে বাছুুরগুলো জড়িয়ে কাঁদছেন। এখন দুধ খাওয়া এসব বাছুরকে বাঁচাতে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন তিনি।
একই রকম ঘটনা ঘটেছে পাশের মন্টু মল্লিক, ওহাব শেখসহ কয়েকটি বাড়িতে। এসব বাড়িতে আবার হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও করা হয়েছে। মন্টু মল্লিকের স্ত্রী নেহারুল বেগম (৩৮) বাড়িতে একা, স্বামী আর সন্তান মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত ৩ দিনে এ বাড়িতে কোনো রান্না হয়নি। ওই নারী নিজেও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এ বাড়ি ও বাড়ি। একই দিন তার বাড়িতেও এ ঘটনা ঘটে। ওই রাতে পুরুষেরা কেউ বাড়িতে ছিলেন না এই সুযোগে প্রতিপক্ষের লোকেরা এসে প্রথমে তার ছেলের খোঁজ করে। তার ঘর খুলে দিতে বলে এসময় নেহারুনকে ঘরের দরজা ভেঙে মারধর করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আর ডাকাতেরা তার সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়।
এরপর খোঁজ নিয়ে জানা গেল এই কারণে এলাকার অন্তত ৫ জন এসএসসি পরিক্ষার্থী তাদের পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
অনেক কষ্টে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। একজন নারী আমাদের কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে গেলেন একটি নির্জন স্থানে। সেখানে আমাদের দেখে কয়েকটি ছেলে ভয়ে দৌঁড়ে পালাতে গেলে সঙ্গে থাকা এলাকার নারীকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে ফিরে আসে। কথা বলে জানা গেল এরা সবাই এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী কয়েকজন আবার এইচএসসি দেবে সামনে।
এদের একজন হিরন মৃধা (১৭) দোয়া মল্লিকপুর গ্রামের হারুন মৃধার ছেলে। সে লক্ষ্মীপাশা আদর্শ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল। ১০ম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে ২০১৫ সালে একটি হত্যা মামলায় সে সাড়ে ৩ মাস জেল খেটে ডিসেম্বর মাসে জেল থেকে বের হয়েছে এরপর আবারো নতুন মামলায় জড়িয়ে সে।
একই রকমভাবে চরমল্লিকপুর গ্রামের ওহাব শেখের ছেলে সজল শেখ (১৭) সেও এবারের এসএসসি পরিক্ষার্থী। স্থানীয় মঙ্গলহাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অন্য সবার মতো সেও পরীক্ষা দিচ্ছিল কিন্তু বাধ সাধলো গ্রাম্য কোন্দল। আর তাতে তার পরীক্ষা শেষ। মাত্র দুটি পরীক্ষা দেবার পরে সে আর পরীক্ষা দিতে পারছে না। দিনের বেলা এখানে সেখানে পালিয়ে সময় কাটাচ্ছে আর রাতে দূরের মামাবাড়ি গিয়ে ঘুমায় এভাবে চলছে এই ছাত্রের দিনরাত। 
হিরনের মতো দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন সেও সাড়ে তিন মাস বিনাকারণে জেলের ঘানি টেনে এসেছে। এখন পর্যন্ত তার নামে ৩টি মামলা রয়েছে।
শুধু তাই নয়, মারধরের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে দোয়া মল্লিকপুর গ্রামের মন্টু মল্লিকের ছেলে বশির মল্লিক (১৭) সেও মল্লিকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো। বর্তমানে সে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করছে। তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানা গেল সেও দুটো পরীক্ষা দিয়ে হামলা আর পুলিশের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে। একই রকম ভাবে পরীক্ষা না দিতে পারা নাজিম শেখ, সাজ্জাদ শেখ।
শুধু এসএসসি পরীক্ষার্থী নয় আতঙ্কে আছে লোহাগড়া সরকারি কলেজের এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী শিহাব মৃধা। সে জানালো, প্রতিনিয়ত লুটপাট আর হুমকির ভয়ে সে বাড়িতে থাকতে পারছে না। তার কলেজ, পড়ালেখা প্রাইভেট টিউটর সব বাদ দিয়ে অন্যদের মতো সেও এখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
এলাকায় ক্রমাগত মামলা আর কোন্দলের কারণে লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে যশোর উপশহর আলীম মাদ্রাসায় পড়ুয়া তরিকুল ইসলামের। মাদ্রাসায় আলীম পড়াকালীন সময়ে গত ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হত্যা মামলায় জেলে যায় সে। সাড়ে ৩ মাস জেল খেটে ডিসেম্বর মাসে বের হয়ে আসে। প্রায় ৪ মাস মাদ্রাসায় অনুপন্থিত থাকার কারণে তাকে আর ক্লাস করতে দেয়নি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। এখন তাকে আবার নতুনভাবে ভর্তি হতে হবে।
এখানেই শেষ নয়। গ্রাম্য কোন্দলে বাদ যাচ্ছে না ঢাকায় পড়ুয়া ছেলেরাও। চর মল্লিকপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিল শেখের ছেলে সাজ্জাদ শেখ সে ঢাকার উত্তরা মডেল ইউনিভার্সিটিতে হিসাব বিজ্ঞানের ৩য় বর্ষের ছাত্র। তার ৩য় বর্ষের পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে এই গণ্ডগোল হলেও মামলা থেকে সেও বাদ পড়েনি। তাকেও হত্যা চেষ্টা মামলার আসামি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, লুটের ভয়ে এলাকার লোকেরা তাদের মালামাল নিয়ে ভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে। এ যেন নিজ ভূমে পরবাসীর মতো অবস্থা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার কয়েকজন অভিযোগে জানান, এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতেই এসব ভাঙচুর আর লুটপাট হয়েছে।
ঘটনার পর থেকে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মল্লিকপুর চৌরাস্তায় লোহাগড়া থানার এসআই শাহিনের নেতৃত্বে প্রায় ১২ জনের একটি পুলিশ দলকে টহল দিতে দেখা গেল। এসআই শাহীন পুলিশের উপস্থিতিতে ভাঙচুর লুটপাটের কথা অস্বীকার করে জানান, বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
লোহাগড়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান জানান, এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে গ্রাম্য দলাদলি বন্ধ করার জন্য আমি স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং ওই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আশা করছি অচিরেই আমরা এ ঘটনার সমাধান করতে পারবো।
এমএএস/এমএস
সর্বশেষ - দেশজুড়ে
- ১ ঠাকুরগাঁওয়ে সারের ডিলারশিপ বাঁচাতে পদ ছাড়লেন ইউপি চেয়ারম্যান
- ২ ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ মনোনয়ন না পাওয়া দুই নেতার সমর্থকদের
- ৩ খুলনায় বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে গণমিছিল
- ৪ ১৫ বছরে দেশ থেকে সাড়ে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে: শিবির সভাপতি
- ৫ মাদারীপুর-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাহারের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ