চার বছরেও শেষ হয়নি সিলেট কারাগারের নির্মাণ কাজ
নগরীর উপকণ্ঠ বাদাঘাটে কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণের কাজ নানা জটিলতায় দ্বিতীয় মেয়াদেও শেষ হয়নি। ফলে জুলাইয়ে কারাগার উদ্বোধন হচ্ছে না বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শুক্রবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অগ্রাধিকারমূলক এ প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হলেও এখনো অনেক ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে মাত্র।
প্রায় ৩০ একর ভূমির ওপর ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক এই কারাগার নির্মাণ কাজ ২০১১ সালের ১১ আগস্টে শুরু হয়। প্রথমে নির্মাণকাল ছিল ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় মেয়াদে সময় প্রায় এক বছর বাড়িয়ে চলতি বছরের জুলাইয়ে কাজ শেষে উদ্বোধন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
তবে এখনো লিংক রোড (রাস্তা নির্মাণ), ড্রেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও কয়েকটি ভবনের নির্মাণ কাজ না হওয়ায় কবে কাজ শেষ হবে তা বলতে পারছেন না গণপূর্ত বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে কমপক্ষে আরো এক বছর লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অথচ সম্প্রতি সিলেটে একটি অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, জুলাই মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তর কাজ শেষ হবে। এরপর পুরাতন কারাগারে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘরসহ সবুজ পার্ক গড়ে তুলতে মহাযজ্ঞ শুরু করা হবে।
নগরীর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বন্দরবাজার সংলগ্ন ধোপদিঘিরপারে শত বছরের পুরনো সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার। ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় এবং কারাগারটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় তা স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)-এ পাস হয় সিলেট কারাগার স্থানান্তর প্রকল্প।
পরবর্তীকালে প্রকল্পের লে-আউট প্ল্যান প্রণয়ন করে সিলেট গণপূর্ত বিভাগ। তাদের অধীনেই নগরীর উপকণ্ঠে বাদাঘাটে নতুন কারাগারের নির্মাণ কাজ চলছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার সময় ছিল ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু রাজনৈতিক ও পরিপার্শ্বিক নানা জটিলতায় এ সময়ের মধ্যে শেষ হয়নি কাজ। 
পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স প্রা. লি., হাবিব কনস্ট্রাকশন, কৈশলী কনস্ট্রাকশন, জেড কনস্ট্রাকশন, ঢালি কনস্ট্রাকশন ও জেবি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পটি শেষ করার মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপরও ধীরগতিতে চলছে কারাগার নির্মাণের কাজ।
গত ১১ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী কারাগার নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেন। জুলাইয়ের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করে সেখানে কারাগার স্থানান্তর করতে নির্দেশ দেন।
সিলেট গণপূর্ত অধিদফতর সূত্র জানায়, নির্মিতব্য কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা দুই হাজার। তবে ভবিষ্যতে তা চার হাজারে উন্নীত করা হবে।
কারাগারে মোট ৬৪টি ভবন নির্মাণ হওয়ার কথা। এর মধ্যে ২৮টি বহুতল, বাকিগুলো একতলা ভবন। এছাড়া স্টিল স্ট্রাকচারড ভবন থাকবে চারটি। কারাগারে পুরুষ বন্দিদের জন্য ৬ তলাবিশিষ্ট চারটি ভবন ও নারী বন্দিদের জন্য চার তলাবিশিষ্ট একটি ভবন থাকবে।
কারাগারে একটি মসজিদ, একটি স্কুল, তিনটি ওয়াচ টাওয়ার, একটি ক্যান্টিন ও একটি গ্যারেজ, হাসপাতাল, সেল, কারা কর্তৃপক্ষের জন্য ১৩০টি ফ্ল্যাট, গার্ড হাউস, ফুড গোডাউন এবং ফুয়েল গোডাউন থাকবে বলে গণপূর্ত বিভাগ জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতার দ্বন্দ্বের কারণে মাটি ভরাট ও নির্মাণ কাজে বেশি সময় লেগেছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদাস কনস্ট্রাকশনের আওতাধীন ফিমেল ওয়ার্ডের পাঁচটি ভবনের মধ্যে তিনটি চারতলা ভবনের কাজ শতকরা ৮০ হয়েছে।
বাকি দুইটি দোতলা ভবনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। এছাড়া ওই ওয়ার্ডের বাইরে বাথরুমের কাজই শুরু হয়নি। 
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণের কাজ ধীরগতিতে হওয়ার কারণ হচ্ছে গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মিজানুর রহমান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করে অফিসের কর্মচারীদের বদলি বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মরত একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নির্বাহী প্রকৌশলী বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে ফায়দা হাসিলে ব্যস্ত থাকেন।
এ ব্যাপারে ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদাস কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী অ্যাড. নুরে আলম সিরাজী জানান, আমার কনস্ট্রাকশনের আওতায় মাটি ভরাট, ফিমেল ওয়ার্ড ও ওয়ার্কশেডের কাজ রয়েছে। এর মধ্যে মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। ফিমেল ওয়ার্ডের পাঁচটি ভবনের মধ্যে তিনটি চারতলা ভবনের কাজ বেশিরভাগ শেষ হয়েছে। আর বাকিগুলোর ডিজাইনই আসেনি।
সিলেট গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, নির্মাণ কাজ কবে শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কিছু বলতে হলে স্টাডি করে বলতে হবে। কত কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, তাও খরচ হিসাব না করে বলা সম্ভব নয়।
তিনি আরো জানান, কারাগার লিংক রোড নির্মাণের সিদ্ধান্ত মাত্র একমাস পূর্বে হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ এখনো শুরুই হয়নি। কারাগারের ৬৪টি ভবনের মধ্যে কয়টি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে তা খেয়াল করেননি। তবে ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণের টেন্ডার হয়েছে। কারাগারের চারপাশে উঁচু সীমানা প্রাচীর ও অভ্যন্তরীণ সীমানা প্রাচীরের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
বর্তমান সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার দেশের প্রাচীনতম কারাগারগুলোর অন্যতম। ১৭৮৯ সালে ধোপাদিঘিরপার এলাকায় আসামের কালেক্টর জন উইলিয়াম প্রায় এক লাখ ভারতীয় রুপি ব্যয়ে ২৪.৬৭ একর জমির ওপর এ কারাগারটি নির্মাণ করেন।
তৎকালীন আসাম রাজ্যের একমাত্র টিবি হাসপাতাল ছিল এ কারাগারেই। প্রশাসনিক প্রয়োজন এবং বন্দি আধিক্যের কারণে ১৯৯৭ সালে কারাগারটি কেন্দ্রীয় কারাগারে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে বন্দি ধারণক্ষমতা ১২০০ হলেও কারাগারে দ্বিগুণের বেশি বন্দি রয়েছেন। এ কারণেই বাদাঘাটে নতুন কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।
এআরএ/এমএস