পেরেকে ক্ষতবিক্ষত গাছ, নেই আইনের প্রয়োগ
দেশের উত্তরের জনপদ গাইবান্ধার সাত উপজেলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছা এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যানার, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে গাছগাছালি। এতে গাছগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মরে যাচ্ছে অনেক গাছ। এতে নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য।
জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ প্রাঙ্গণ, বাজার, সড়কের পাশে ছোট-বড় সব ধরনের গাছে পেরেক দিয়ে ছিদ্র করে ব্যানার, ফেস্টুনগুলো সাঁটানো হয়েছে। এতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে পরিবেশের বন্ধু গাছ। গাছে পেরেক ঠুকে এভাবে সাইনবোর্ড সাঁটানো সরকারিভাবে নিষেধ থাকলেও আইন বাস্তবায়ন না থাকায় তা মানছেন না কেউ।
গাইবান্ধা পৌরশহরসহ জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্লাপুর, সাঘাটা, ফুলছড়ি উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, সড়কের দুধারে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা গাছে নেতাকর্মীদের পরিচিতি ও শুভেচ্ছা সম্বলিত চটকদার ব্যানার ঝুলছে। ঝুলে আছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক ও হারবাল ওষুধ কোম্পানির অসংখ্য সাইনবোর্ড। সেগুলো সাঁটাতে পেরেক ঠুকানোয় গাছগুলো থেকে বের হচ্ছে আঠাজাতীয় তরল পদার্থ। শুকিয়ে যাচ্ছে লতাপাতা, ডালপালা। এর ধকল সইতে না পেরে কোনোটি মরেও গেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, গাছের পরিবহন সিস্টেম হলো জাইলেম আর ফ্লোয়েম। পানির সঙ্গে দ্রবীভূত খনিজ লবণও জাইলেম টিস্যুর মাধ্যমে ওপরে প্রবাহিত হয়। আবার গাছের পাতা থেকে যে খাদ্য তৈরি হয়, সেটা গাছের বাকল দিয়ে ভেতরে যায়। বাকলের নিচে ফ্লোয়েমের অবস্থান। পাতা থেকে সেটা গাছের নিচের দিকে আসে। যদি গাছে ছোট আকারের পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়, তাহলে ফ্লোয়েম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে পাতায় উৎপাদিত খাদ্য সঞ্চালনে বাধা পাবে। আর যদি বড় পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়, তাহলে পানি ও খনিজ লবণ সঞ্চালনে বাধা পাবে। এমনকি সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত গাছের পাতা ছেঁড়া বা গাছ কাটা যাবে না। এ সময়ে গাছ খাদ্য গ্রহণ তথা শোষণ করে।
সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সড়কের পাশের বেশিরভাগ গাছে বেশকটি করে পেরেক মেরে বোর্ড টাঙানো হয়েছে। গাছে নির্বিচারে পেরেক লাগানোর কারণে সড়কের অনেক গাছ মরে যাচ্ছে। পেরেক মারা বন্ধ না হলে গাছগুলো মরে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।’
ফুলছড়ি উপজেলার কাঠমিস্ত্রি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এখন কাঠের অনেক দাম। কিন্তু পেরেক মারায় তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই স্থানে পচন ধরছে। ফলে আর্থিকভাবেও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় বাটালের মুখও নষ্ট হয়। পরে দেখি সেখানে পেরেক বা লোহা রয়েছে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘গ্রিন ভিলেজ গাইবান্ধা’র প্রতিষ্ঠাতা আসাদ নুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষের ন্যায় গাছেরও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। মানুষের শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে চিকিৎসা না করালে তাতে পচন ধরে। একসময় সেই অঙ্গ কেটে ফেলতে হয়। আবার কখনো পচনের মাত্রা শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢুকে জীবনের বিনাশ ঘটায়। একইভাবে ছিদ্র করা অংশে পচন ধরে একপর্যায়ে গাছ মরে যায়।’
এ বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক আবু সোলায়মান সরকার জাগো নিউজকে বলেন, পেরেক লাগানোর কারণে গাছের গায়ে যে ছিদ্র হয়, তা দিয়ে পানি ও এর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া এবং অণুজীব ঢোকে। এতে গাছের ওই জায়গায় দ্রুত পচন ধরে। ফলে খাদ্য ও পানি শোষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। পরবর্তী সময়ে গাছ মারাও যেতে পারে।
সামাজিক বনায়ন জোন গাইবান্ধার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএইচএম শরিফুল ইসলাম মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘গাছে পেরেক মারা অন্যায়। পেরেক মারলে গাছের ওই অংশে পানি জমে পচে গিয়ে গাছ মরে যেতে পারে। সবার উচিত গাছে পেরেক না মারা।’
এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. অলিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, পেরেক দিয়ে গাছ ছিদ্র করে বিলবোর্ড সাঁটানো আইনবিরোধী কাজ। আইন প্রয়োগের চেয়ে জনসচেতনতাই পারে এটি প্রতিহত করতে। সেক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হওয়া দরকার। দ্রুত অভিযান চালিয়ে এগুলো অপসারণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
শামীম সরকার শাহীন/এসআর/এএএইচ