কেমন আছেন নওগাঁর হরিজন কলোনির বাসিন্দারা?
বছর বছর বেড়েছে জনসংখ্যা। বাড়েনি জমির পরিমাণ। সামান্য ভূমিতে মাথা গোজার জন্য করা হয়েছে ঝুঁপড়ি ঘর। সেখানেই গাদাগাদি করে বসবাস। এতে হয়েছে ঘনবসতি। এমন পরিস্থিতিতে প্রাণ যেনো ওষ্ঠাগত অবস্থা। কমেছে কর্মসংস্থান। আয়ের জন্য খুঁজতে হচ্ছে বিকল্প পথ। এমন অবস্থা নওগাঁ শহরের হরিজন কলোনির।
জানা যায়, ১৯৬৩ সালে নওগাঁ পৌরসভার যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত সুইপারদের (হরিজন সম্প্রদায়) জন্য স্থায়ী কোনো আবাসন ব্যবস্থা ছিল না। সুইপারদের অধিকাংশই হরিজন সম্প্রদায়ের। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৫ সালে নওগাঁ পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল জলিল শহরের হাট-নওগাঁ এলাকায় মাছ বাজারের পাশে দুই একর জায়গার ওপর একটি কলোনি গড়ে তোলেন। সেখানে তাদের বসবাসের জন্য ২৫টি আধাপাকা ঘর তৈরি কর হয়। এটি বর্তমানে হরিজন পল্লী হিসেবে পরিচিত। এরপর জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের জন্য পৗরসভা থেকে নতুন করে কোনো ঘর কিংবা আলাদা কোনো জমি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি।

সরেজমিনে দেখা যায়, নওগাঁ শহরের মাছ বাজারের পুকুরের উত্তর-দক্ষিণ পাড়ে দুটি সড়ক। এ সড়কই কলোনির প্রবেশ পথ। তবে পুকুরের উত্তর পাড়ে মূল দরজা। এ দরজার পাশে দিনের অধিকাংশ সময় হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন বসে ও গল্প করে সময় পার করেন। পুকুরের মধ্যে পশ্চিম পাড়ে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর আরসিসি পিলারের ওপর তাদের ঘর। স্থান সংকুলান না হওয়ায় নিজেদের অর্থে এসব ঘর করা হয়েছে।
এ কলোনিতে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর তিন সারিতে রয়েছে ঘরবাড়ি। একটি গলির (রাস্তা) দৈর্ঘ্য ৪-৫ ফুট হলেও দ্বিতীয়টির দৈর্ঘ্য প্রায় দুই থেকে আড়াই ফুট। প্রথম গলিতে হাওয়া-বাতাস প্রবেশ করতে পারলেও দ্বিতীয় গলিতে তার দেখা পাওয়া সম্ভব না। এসব খুপড়ি ঘরেই বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি, নাতি-নাতনি নিয়ে তাদের বসবাস। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যেই রান্না আর থাকা-খাওয়া। উৎকট গন্ধের মধ্যেই গলিতে শিশুরা খেলা করছে। আবার কেউ এ গলিতে অস্থায়ী চুলায় রান্না করছেন।
পৌরসভা থেকে যে ২৫টি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিভিন্ন সময় কলোনির বাসিন্দারা ফাঁকা জায়গায় আরও আধাপাকা ঘর গড়ে তুলেছেন। এতেও আবাসন সংকট নিরসন দূর হচ্ছে না। আর জায়গা না থাকায় নতুর করে ঘর নির্মাণ করতে পারছেন না তারা। ফলে কোনো কোনো পরিবারে ছয়-সাত জন সদস্য নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস করতে হচ্ছে। সেখানে ২০০টি ঘরে প্রায় ৬৫০ জনের বসবাস।
সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় ২০০৭ সালের পর যাদের জন্ম তাদের মাঝে শিক্ষিতের হার ৭০ শতাংশ। তবে বড়দের মধ্যে শিক্ষিতের হার কম। যেখানে এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে ৩০ জন। উচ্চ মাধ্যমিক ১০ জন। স্নাতক পাস করেছেন সাতজন।

কলোনির বাসিন্দারা জানান, পৌরসভায় ১৩০ জন ঝাঁড়ুদারের কাজ করেন। যাদের মাসিক সম্মানি এক হাজার টাকা। সম্মানি বাড়ানোর জন্য বারবার মেয়রকে অবগত করা হলেও কর্নপাত করেন না। মাসিক সম্মানি বাড়ানোসহ কর্মসংস্থান বাড়ানো দাবি জানান তারা।
কলোনির বাসিন্দা মালা হাড়ি বলেন, এক ঘর, এক বারান্দা। যেখানে স্বামী-স্ত্রী, দুই সন্তানসহ ছয় জন বসবাস করতে হয়। বলা যায় গরুর গোয়ালে বসবাস করা। বাড়িতে প্রবেশ করতে হয় দুই হাত সরু গলি দিয়ে। কোনোরকম বাতাস বাড়িতে ঢুকতে পারে না। এই গরমে ঘরে থাকাই কষ্টকর হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎ চলে গেলে বাড়ির বাহিরে দূরে গিয়ে বসে থাকতে হয়।
হরিজন কলোনির হাড়ি সম্প্রদায়ের মণ্ডল স্বভাব হাঁড়ি বলেন, পৌরসভা থেকে একটি ঘর পেয়েছি। ওই ঘরে গাদাগাদি করে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতাম। ১০ বছর আগে পুকুরের মধ্যে আরও তিনটি ঘর করেছি। মোট চারটি ঘরে স্ত্রী, তিন ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিসহ ১১ জন বসবাস করছি। ঝুঁপড়ি ঘরে পাখির মতো বসবাস করছি বলা যায়। পাখিরাও স্বাধীনভাবে বসবাস করে।
কলোনির বাঁশফোড় সম্প্রদায়ের যুগ্ম সম্পাদক চন্দন কুমার বাঁশফোড়। তিনি নওগাঁ সদর উপজেলায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি করছেন। অভিযোগ করে বলেন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা থাকায় ২০০৭ সালের পর থেকে আমাদের সম্প্রদায়ে শিক্ষিতের হার বাড়ছে। তবে কোনো অফিস-আদালতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হলে সেখানে আমাদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে না। অর্থের বিনিমিয়ে অহরিজনদের (অন্য ধর্মের) চাকরি দেওয়া হয়। এতে করে আমরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছি। বর্তমানে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে খরচ বেশি হলেও আমাদের আয় সীমিত। এখন ঘাটতি মেটাতে অনেকেই মাদক ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

হরিজন কলোনির বাঁশফোড় সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদক বয়জেষ্ঠ্য নানকা বাঁশফোড় বলেন, আগে আমরা শহরের ডিম বাজারে বসবাস করতাম। তখন বাঁশফোড় ও হাড়ি সম্প্রদায় ১৫০ জন মানুষ ছিল। ওখানে সবজি, ডিম ও পান বাজার তৈরি হওয়ার পর আমাদের সেখানে আর জায়গা হলো না। এরপর ১৯৮৫ সালে মাছ বাজারের পাশে পুকুর পাড়ে আমাদের বসবাসের জন্য ২৫টি আধাপাকা ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না।
হরিজন কলোনির হাড়ি সম্প্রদায়ের সহ-সভাপতি প্রভাস কুমার হাড়ি বলেন, এ কলোনিতে ২০০টি পরিবার রয়েছে। যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ৬৫০ জন হবে। আমাদের প্রধান সমস্যা আবাসন। অনেক কষ্ট করে প্রতিটি বাড়িতে পাঁচ থেকে আটজন বসবাস করে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। অগ্নিকাণ্ড হলে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণহানি হবে। গত এক যুগ থেকে শুনছি আমাদের আবাসন করে দেওয়া হবে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পুকুরের মাঝ বরাবর গাইড ওয়াল নির্মাণ করে দিলে আমরাই ঘর-বাড়ি তৈরি করে নিতে পারবো। আমাদের শহর থেকে দূরে রাখা হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা সম্ভব না।
নওগাঁ পৌরসভার মেয়র নজমুল হক সনি বলেন, হরিজন সম্প্রদায় মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এবং আবাসিক সমস্যা সমাধানে চারতলা ভবনের জন্য একটি প্রজেক্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আশা করছি, দ্রুত কাজ শুরু হবে। এতে করে তাদের দীর্ঘদিনের আবাসন সমস্যা সমাধান হবে।
বেতন বৃদ্ধি নিয়ে মেয়র বলেন, পৌরসভায় চাকরি করাসহ প্রায় ২০০ জনের মতো ঝাঁড়ুদার আছে। প্রকৃতপক্ষে যারা কাজ করে তারা যদি বেতন নেয় মাসে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া সম্ভব। কিন্তু মাসে ৮-১০ জন ঝাঁড়ুদারের কাজ করে।
এমআরআর/এমএস