ভুতুড়ে হাসপাতালে হরিলুট কারবার
উত্তর সীমান্তের দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলছে হরিলুট কারবার। সেখানে অপারেশন থিয়েটার ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, ওয়ার্ডবয় সবকিছুই আছে। তবে সেটি কাগজে কলমে। বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটি রূপ নিয়েছে লুটপাটের আখড়ায়।
সপ্তাহে দু-তিনদিন দুই ঘণ্টার জন্য খোলা হয়। কিন্তু কোনো সেবাই পান না এলাকার মানুষ। একযুগ ধরে এভাবেই সরকারি বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে খাওয়া হচ্ছে। সরেজমিনে দহগ্রাম ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এনক্লেইভ (রাষ্ট্রের যে অংশ অন্য রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত)। লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার তিনবিঘা করিডোরকে দেশের সাবেক ছিটমহলও বলা হয়। ১৮ দশমিক ৬১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ গ্রামে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বাস। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে করিডোরটি উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুন: ভোলায় মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে জলাবদ্ধতা, পানি মাড়িয়ে আসছেন রোগী
এর আগে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় কোনো হাসপাতাল ছিল না। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দহগ্রামে একটি ১০ শয্যার হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। পরে সেটি ২০ শয্যায় উন্নীত হয়। তবে শুরু থেকে কাগজ-কলমে হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। একদিনের জন্যও আন্তঃবিভাগ সেবা পাননি স্থানীয়রা। বহির্বিভাগেও সেবা নেই বললেই চলে। প্রায় সবসময়ই সেখানে লোহার বন্ধ গেটে তালা ঝুলতে দেখা যায়।

পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম দাবি করেন, দহগ্রাম হাসপাতালে দায়িত্বরতরা অফিস সময়সূচি মেনে বহির্বিভাগে সেবা দেন। সেখানে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ রোগী দেখা হয়। তাদের চাহিদামতো সরকারি বরাদ্দের ওষুধও সরবরাহ করা হয়।
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসপাতালের ফটক খোলা দেখে বহির্বিভাগে ঢোকা রোগীকে জ্বরের জন্য নাপা আর সর্দির জন্য হিস্টাসিন ওষুধ ছাড়া কিছুই দেওয়া হয় না। এখন বাজারে প্রতি পিস নাপা ট্যাবলেটের দাম ৮০ পয়সা আর হিস্টাসিনের দাম পড়ে ২৯ পয়সা। এ হিসাবে একজন রোগীকে পাঁচটি করে ওষুধ বিনামূল্যে দিলে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা খরচ হয়। সপ্তাহে গড়ে দুদিন দুই ঘণ্টার জন্য হাসপাতাল খোলা থাকা সাপেক্ষে গড়ে ১০০ রোগীকে দেওয়া ওষুধের দাম দাঁড়ায় ৫৪৫ টাকা। মাসের হিসাবে দুই হাজার ১৮০ টাকা, আর বছরে ২৬ হাজার ১৬০ টাকা।
অর্থাৎ হাসপাতালটিতে শুধু ওষুধের জন্য বরাদ্দের ২১ লাখ টাকার মধ্যে খরচ হচ্ছে মাত্র ২৬ হাজার ১৬০ টাকা। বাকি ২০ লাখ ৭৩ হাজার ৮৪০ টাকার ওষুধ নিয়ে চলে লুটপাট।
আরও পড়ুন: একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে চলছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
এছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনা হয় পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকায়। যদিও প্রাথমিক চিকিৎসা কিংবা অস্ত্রোপচার কোনোটাই এ হাসপাতালে হয় না। ফলে বরাদ্দের পুরো টাকাই আত্মসাৎ হয় বলে জানান পাটগ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এদিকে আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো কারণ ছাড়াই ১২ বছর ধরে আন্তঃবিভাগ বন্ধ। বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিতে সপ্তাহে দু-তিনদিন শুধু প্যারাসিটামল ও সর্দির ট্যাবলেট নিয়ে দুই ঘণ্টার জন্য হাসপাতাল খুলে বসেন ওয়ার্ডবয়। সময় হলে ইচ্ছামতো চিকিৎসক আসেন। তবে তিনি রোগী দেখেন না। দুপুর ১২টার পর হাসপাতালের গেটে তালা ঝুলতে দেখা যায়। গ্রামের লোকজন অসুস্থ কিংবা দুর্ঘটনা ঘটলে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে ছুটতে হয় উপজেলা সদরে পাটগ্রাম হাসপাতালে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে চারজন চিকিৎসকের মধ্যে দুজন দায়িত্বরত। এরমধ্যে ১২ বছর হলো রয়েছেন ডা. নুর আরেফিন কল্লোল ও দেড় বছর হলো ডা. হাসান আল মামুন। এছাড়া সিনিয়র নার্স হিসেবে রয়েছেন জান্নাতুল জিন্নাত, নুরাইয়া জান্নাতুল, আকরামুজ্জামান ও শাহরিয়ার রহমান। অফিস সহকারী পদে ধনঞ্জয় বর্মণ ছুটি না নিয়েই বছরের পর বছর অনুপস্থিত। ওয়ার্ডবয়ের দুটি পদে রয়েছেন মিজানুর রহমান ও জয়নাল আলী। কুকের দুটি পদে সাহেরা খাতুন ও আব্দুল জোব্বার। আর পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদে নন্দলাল বাসফোড়। সরকারি কাগজপত্র অনুসারে এরা সবাই তাদের কর্মস্থলে নিয়মিত সেবা দেন। যদিও সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে কাউকেই হাসপাতালে পাওয়া যায়নি।
পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান সহকারী খালেদা আক্তার রীনা বলেন, দহগ্রামে দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রতি মাসে সরকারের রাজস্ব খাত থেকে বেতন উত্তোলন করেন। তবে কে কতো টাকা বেতন পান সেই তথ্য তিনি জানাতে পারেননি।
তিনি বলেন, আগে আমি বেতন শিট তৈরি করতাম। এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিজেই এ কাজটি করেন।
অনুসন্ধানকালে জানা যায়, দহগ্রামে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা এ হাসপাতাল থেকে নিয়মিত বেতন তুললেও দায়িত্ব পালনে নিয়মিত নন। তারা সপ্তাহে কিছু সময়ের জন্য হাসপাতালে যান। তবে কোনো রোগী না দেখে ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পর আবার ফিরে যান।
আরও পড়ুন: বরিশালে একদিনে সর্বোচ্চ ৩৪৮ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত
ওয়ার্ডবয় মিজানুর রহমান পরিবার-পরিজন নিয়ে চিকিৎসকের একটি কোয়ার্টারে থাকেন। রোগীদের থাকার বেডগুলো নিজের কোয়ার্টারে নিয়ে বেড হিসেবে ব্যবহার করছেন। বাড়ির চারদিকে লোহার শক্ত গ্রিল এমনভাবে লাগানো যে বাইরে থেকে ঢোকা বা দেখার উপাই নেই। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও মিজানুর কোনো তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেননি।
তবে অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, ওয়ার্ডবয় মিজানুরের পরিবার দহগ্রামের কোয়ার্টারে থাকলেও তাকে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পাটগ্রাম সদরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে ওই কর্মকর্তার একান্ত সহকারীর কাজ করেন তিনি।
হাসপাতালে হরিলুট কারবার
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও পড়ে থাকা ভবনগুলো। পোকামাকড়ের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে ভেতরের অংশ। চিকিৎসক ও নার্সদের বসবাসের জন্য তৈরি আটটি কোয়ার্টার পড়ে রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। রোগী পরিবহনের দুটি অ্যাম্বুলেন্স প্রদান করা হয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। এরমধ্যে একটি ব্যবহার না করে নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যটি স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নির্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাটগ্রাম সদরে। সেখানে বাইরের রোগী (আন্তঃজেলা) পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হয় অ্যাম্বুলেন্সটি।
হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার, আধুনিক এক্স-রে মেশিন, উন্নত যন্ত্রপাতি, নারী-পুরুষ ওয়ার্ডের পাশাপাশি অস্ত্রোপচার করা রোগীদের রাখার বিশেষ ব্যবস্থা, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর,
অ্যাম্বুলেন্সসহ নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যবহার না করায় কোটি টাকা মূল্যের এক্স-রে মেশিন, জেনারেটর, অপারেশন থিয়েটারের সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নির্দেশে পাটগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
উঠছে বেতন ভাতা, হচ্ছে গায়েবি মেরামত
সরকারি তথ্যমতে কাগজে-কলমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের দিন থেকে দহগ্রাম হাসপাতালে আন্তঃ ও বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এখানে কর্মরত দেখিয়ে প্রতিমাসে দুজন প্রথম শ্রেণির, চারজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা এবং বাকি ছয়জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বেতন উত্তোলন করছেন। বছরে এই হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য ২১ লাখ টাকার ওষুধ ক্রয় করা হয়। এছাড়া অতিরিক্ত প্রয়োজন, অন্যান্য সরঞ্জাম ও টুকিটাকি কেনাকাটার জন্য বরাদ্দ থাকে আরও ৭ লাখ টাকা। প্রতি বছরই বড় ধরনের মেরামত কাজও করে স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ। উদ্বোধনের পর ১২ বছর ধরে চলছে এ একই ধারা।

এই হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. নুর আরেফিন কল্লোল ও ডা. হাসান আল মামুন দাবি করেন, তারা নিয়মিত রোগী দেখেন ও ব্যবস্থাপত্র দেন। এছাড়া সেখানে কর্মরত অন্য কর্মচারীরাও নিয়মিত অফিস করেন।
ভুক্তভোগীদের আকুতি
দহগ্রাম ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান ফিরোজ বলেন, উদ্বোধনের পর থেকে আমি কখনো এ হাসপাতাল খোলা থাকতে দেখিনি। সাধারণত হাসপাতাল ও থানার মানুষের সেবার জন্য সব সময় খোলা থাকে। কিন্তু এখানে তার বিপরীত চিত্র। প্রধানমন্ত্রী দহগ্রামের মানুষের জন্য এত বড় একটি হাসপাতাল দিয়েছেন। কিন্তু কিছু মানুষের অবহেলা ও অযত্নে এ সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।
দহগ্রাম থানাপাড়ার বাসিন্দা কবির উদ্দিন বলেন, ওয়ার্ডবয়ের কাছ থেকে জ্বর, সর্দি, কাশির মতো টুকিটাকি ওষুধ পাওয়া যায়। তাও সেটা সপ্তাহে দু-একবার। বড় ডাক্তার কখনো এখানে আসতে দেখিনি। আমাদের কোনো সমস্যা হলে পাটগ্রাম যেতে হয়।
১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাইদুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহার এরা লুটেপুটে খাচ্ছে। বহির্বিভাগে ডাক্তারের পরিবর্তে রোগী দেখে ওষুধ দেন ওয়ার্ডবয়। এদের কাছ থেকে নেওয়া ওষুধ খেয়ে বড় রকমের বিপদ হতে পারে। কারণ তারা কোন রোগীকে কী ওষুধ দিচ্ছে সেটা বলা মুশকিল।
গৃহবধূ আমেনা বেগম জানান, আমার নিজের বা কোলের শিশুর কোনো সমস্যা হলে স্বাস্থ্যসেবার জন্য পাটগ্রাম হাসপাতালে যেতে হয়। গ্রামের এ হাসপাতালটি শুধু নামেই রয়েছে। মাঝে মাঝে দুই ঘণ্টার জন্য কিছু ওষুধপত্র দেওয়া হয় মাত্র।

কর্তৃপক্ষ যা বলছে
পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, দহগ্রামের জন্য জরুরি বিভাগে চারজন, বহির্বিভাগের জন্য দুজন, আন্তঃবিভাগে একজন (আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা) করে চিকিৎসক ও ২১ জন নার্সের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে ডে গার্ড, নাইট গার্ড, সুইপার, আয়া, বুয়া ও রাঁধুনি।
সাইফুল ইসলাম দাবি করেন, বর্ধিত এ লোকবলের অভাবেই প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জন করে রোগী দেখেন দায়িত্বরত চিকিৎসকরা। একইসঙ্গে তাদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়। দায়িত্বহীনতার অভিযোগটি সঠিক নয়।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায় বলেন, দহগ্রামে নিয়মিত বহির্বিভাগ সেবা চালু রয়েছে। প্রতিদিন নিয়মমতো রোগী দেখা ও ওষুধ সরবরাহ করা হয়। হাসপাতাল প্রায়ই বন্ধ থাকার অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।
এফএ/এএইচ/জিকেএস