হারিয়ে যাচ্ছে মাদারীপুরের ঐতিহ্যবাহী ‘পর্বত বাগান’
যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে পর্বত বাগানের স্থাপনাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে
মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের বড় বাড্ডা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন রাসবিহারী পর্বত। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ। ময়মনসিংহ জমিদারি সেরেস্তার নায়েবের চাকরি করতেন তিনি।
চাকরি থেকে অবসরের পর রাসবিহারী পর্বত নিজ গ্রামে শখের বশেই গড়ে তুলেছিলেন একটি বাগান। পরবর্তীকালে তার নামানুসারে সেই বাগানের নাম হয় ‘পর্বত বাগান’। যা আজও মাদারীপুরের ঐতিহ্য বহন করছে। তবে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দিনদিন পর্বত বাগানের সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৩০ সালে রাস বিহারী পর্বত দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০০ জাতের ফল ও ফুলের চারা সংগ্রহ করে প্রায় ২০ একর জমির ওপর গড়ে তোলেন এই বাগান। সেই থেকে তার নামানুসারে এ বাগানটি ‘পর্বত বাগান’ নামে পরিচিতি পায়।
বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা কুমার নদ বাড়তি সৌন্দর্য এনে দেয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে হাজার হাজার নারকেল ও সুপারি গাছ বাগানটিকে ঘিরে রেখেছিল। ছিল আম, জাম, কাঁঠাল, কামরাঙা, আমড়া, কুল, সফেদা, জলপাই, আমলকি, কমলা, জামরুল, তেজপাতা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফল ও ভেষজ গাছ। বাগানটিকে নয়নাভিরাম করার জন্য ছিল গোলাপ, গন্ধরাজ, টগর, কামিনী, হাসনাহেনা, বকুল, জুঁই, বেলি, জবাসহ অসংখ্য ফুলের গাছ।

একসময় শীতকালে বাগান সংলগ্ন পুকুরে আগমন ঘটতো বিচিত্র পাখির। ফলে খুব সহজেই আকৃষ্ট হতেন পর্যটকরা। বাগানের মধ্যে ছয়টি শান বাঁধানো পুকুর ও রাসবিহারী পর্বতের বাসভবনটি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এগুলো এখন পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। অথচ এক সময় বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের মধ্যে আর কোথাও চিত্ত-বিনোদন এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো এমন নয়নাভিরাম পরিবেশ দ্বিতীয়টি ছিল না। অথচ আজ তা দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় কিছু রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের হাতে রাসবিহারী পর্বত খুন হন। এসময় তার স্ত্রী-সন্তানরা বাড়ি চেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন। তখন স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাগানের গাছপালা কেটে নিয়ে যান। এরপর থেকেই বাগানটি তার ঐতিহ্য হারাতে শুরু করে।

স্বাধীনতার পর রাস বিহার পর্বতের পরিবার বাগানটি উদ্ধার করে আবার বসবাস শুরু করেন। রাসবিহারী পর্বতের স্ত্রী শোভরাণী পর্বত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে মারা যান। তার দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে রাজেন্দ্র বিহারী পর্বত এখন বাগানের দেখাশোনা করেন এবং ছোট ছেলে রণজিৎ বিহারী পর্বত একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এখনো বাগানের মধ্যে রাসবিহারী পর্বতের ১৪ কক্ষবিশিষ্ট দোতলা বাসভবন, একটি মন্দির এবং বাবা রাজকুমার পর্বত ও মা বিধুমুখী পর্বতের দুটি সমাধিসৌধ ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আছে।
রাসবিহারী পর্বতের বড় ছেলের স্ত্রী মালতী রাণী পর্বত বলেন, বাড়ির গাছপালা ও পুকুর লিজ দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলে। এখনো অনেকেরই এই সম্পত্তির ওপর লোভ আছে। আমরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকি। তাছাড়া এখানকার প্রভাবশালীরা একটু একটু করে বাগান দখল করে নিচ্ছে। ভয়ে আমরা কিছু বলতেও পারি না।

এ বিষয়ে মাদারীপুরের পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অব নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদ বলেন, এ বাগানে অনেক দুর্লভ প্রজাতির গাছ আছে, যা রক্ষা করা প্রয়োজন। সরকার ইচ্ছা করলেই দক্ষিণ বাংলার ঐতিহ্য এ বাগানটি বিনোদনকেন্দ্র হতে পারে।
তিনি বলেন, আগে এখানে অনেকে ঘুরতে আসতেন। এখন মৌসুমে দু-একটি পিকনিক পার্টি ছাড়া পর্যটকদের দেখা যায় না। রক্ষা হলে আবার হয়তো পরিবেশপ্রেমী সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে ঐতিহ্যবাহী এই পর্বত বাগান।

মাদারীপুরের ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, বর্তমানে মাদারীপুরে এত বড় একটি মনোরম বাগান তৈরি করা সম্ভব হবে কি না তা বলা মুশকিল। তাই দক্ষিণ বাংলার পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বাগানটি সংরক্ষণ করা সম্ভব। মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলী দিয়ে তৈরি কুমার নদ ঘেরা পর্বত বাগানের নৌ এবং স্থলপথে প্রবেশের সুবিধা রয়েছে। সরকারের অচিরেই বাগানটিকে দক্ষিণ বাংলার পর্যটককেন্দ্র রক্ষা করা উচিত।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন বলেন, এই পর্বত বাগানটি মাদারীপুর জেলার ঐতিহ্য বহন করে। এটিকে আরও মনোমুগ্ধকর করতে পারলে জেলার মানুষের পাশাপাশি পর্যটকও আসবে।
এমআরআর/এমএস