ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৩:১২ পিএম, ২৭ জুলাই ২০২৫

আগামী বছর এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। এই উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ দুটোই বয়ে আনবে। ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এখনই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জোরেশোরে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অনেক বাণিজ্যিক সুবিধা কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সেই ঝুঁকি মোকাবিলায় রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক করা, রাজস্ব আদায় বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বাণিজ্যসহায়তা সহজীকরণ এবং নতুন বাজার খুঁজে বের করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, তবে সুযোগও অনেক বেশি থাকবে।

তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ এবং পিটিএ করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেহেতু প্রণোদনা উঠে যাবে সেহেতু এলডিসি উত্তরণের পর ব্যবসায়ীদের বিকল্প উপায়ে সহযোগিতা দিতে হবে। পণ্য বৈচিত্র্যকরণ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর জোর দিতে হবে।

আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা ও ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাণিজ্যিক সুবিধা কমে যাওয়ার অনেক ঝুঁকি রয়েছে। সেই ঝুঁকি মোকাবিলায় রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক করা, রাজস্ব আদায় বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বাণিজ্যসহায়তা সহজীকরণ এবং নতুন বাজার খুঁজে বের করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

তিনি বলেন, এলডিসিতে থাকার কারণে বাংলাদেশ কিছু বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করে। উত্তরণের পর এই সুবিধাসমূহ হারানোর ফলে রপ্তানি বাণিজ্যে যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে তা মোকাবিলায় কার্যকরী পদক্ষেপ এখন থেকেই গ্রহণ করতে হবে। নতুন বাজারের খোঁজ এবং প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে, যা বর্তমানে এলডিসি সুবিধা দিয়ে সহজ পর্যায়ে রয়েছে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে সাকিফ শামীম বলেন, এলডিসি সুবিধা কমে যাওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে সরকারের আয়ও কমতে পারে। এছাড়া নতুন বাজার খুঁজে বের করা এবং সেখানে নিজেদের পণ্য ও সেবা বাজারজাত করার বিষয়ে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।

বেসরকারি খাতকে এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি সব অংশীদারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে প্রস্তুত না হয় তাহলে এলডিসি থেকে উত্তরণ সার্বিক অর্থনীতির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি।

তিনি আরও বলেন, সাড়ে ৪ কোটি ব্যবসায়ীই এদেশের অর্থনীতির প্রাণ। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৮০ শতাংশ আসে ব্যবসায়ীদের হাত দিয়ে। তাই এলডিসি উত্তরণের প্রধান চ্যালেঞ্জও নিতে হবে ব্যবসায়ীদের।

বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এলডিসি গ্রাজুয়েশন পাঁচ বছর পিছিয়ে দিলে ভালো হয় মন্তব্য করে সকিফ শামীম বলেন, কিন্তু সেটি এখন আর সম্ভব নয়। আগামী বছর বাংলাদেশ এলডিসি দেশের তালিকা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই এখনই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণের পর বিশ্ববাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার, বিভিন্ন খাতের বাণিজ্যিক প্রণোদনা, জিএসপিসহ নানান সুবিধা রহিত হবে এবং এর সঙ্গে সার্বিক রপ্তানির ওপর চাপ পড়বে। এই উত্তরণ দেশের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি কিছু সুযোগ নিয়ে আসবে। তবে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এবং সুযোগগুলো কাজে লাগাতে প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। উত্তরণের পর এলডিসিতে থাকার সুবিধাগুলো পর্যায়ক্রমে কমে আসবে, ফলে রপ্তানি পণ্যের খরচ বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক এবং ওষুধ শিল্পের ওপর এর বড় প্রভাব পড়তে পারে।

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, গ্রাজুয়েট হওয়ার অর্থ হলো অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধাগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া। রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে এমন পোশাক খাত, গ্রাজুয়েট পরবর্তীসময়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে ৮-১২ শতাংশ শুল্কের সম্মুখীন হবে। এডিবি এবং জাতিসংঘের তহবিলের মতো দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সফ্ট লোন এবং অনুদানের সুবিধা হারাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তে (কনসেশনাল) ঋণপ্রাপ্তির সুযোগও সীমিত হয়ে যেতে পারে। সুদের হার এবং পরিশোধের শর্তাবলি আরও কঠোর হবে।

সাকিফ শামীম বলেন, মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি পরিপালন-ট্রিপস চুক্তির কঠোর বিধিমালা মেনে চলতে হবে, যা ওষুধ শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বর্তমানে এলডিসি হিসেবে এ শিল্প কিছু ছাড় পায়। কিন্তু এলডিসি উত্তরণের পর রয়্যালটি পরিশোধের মতো বিষয়গুলোতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর পর দেশীয় পণ্যকে আন্তর্জাতিক বাজারে সরাসরি প্রতিযোগিতা করতে হবে, রপ্তানি বৈচিত্র্য না থাকলে যা চ্যালেঞ্জিং হবে। উন্নত দেশগুলো থেকে ক্রেতা এবং ভোক্তারা শ্রম ও পরিবেশগত মানদণ্ড পূরণের ওপর আরও বেশি জোর দেবে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং উত্তরণের সুযোগগুলোও কাজে লাগানোর জন্য এখনই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য যা করতে হবে তা হলো উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ব্যবসা পরিচালনার খরচ কমাতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি কমিয়ে একটি স্বচ্ছ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। লজিস্টিকস ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিবহন ও লজিস্টিকস অবকাঠামোর উন্নয়ন করে পণ্য রপ্তানির খরচ কমাতে হবে। বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং অধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

সাকিফ শামীম বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে কঠোর রুলস অব অরিজিন এবং ক্রিয় সেফগার্ড ক্লজ প্রয়োগের কারণে রপ্তানি আরও কমানো হতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মেনে বাণিজ্য নীতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার অনতে হবে। দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিনিয়োগ নীতি এবং প্রণোদনাগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বিশেষ করে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে জন্য উন্নত অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ, সহজ ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।

বর্তমানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব অবকাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠা একটি বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক কূটনীতি শক্তিশালীকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলা এবং কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় জোর দিতে হবে। জিডিপি ও রপ্তানির সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা এবং আর্থিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনা প্রয়োজন।

আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে এই সহ-সভাপতি প্রার্থী আরও বলেন, সরকার এরইমধ্যে স্মুথ গ্রাজুয়েশন স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেছে, যেখানে বিভিন্ন সুপারিশ রয়েছে। এই সুপারিশগুলোর দ্রুত অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। এলডিসি উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য বিশ্বমঞ্চে আত্মমর্যাদা ও সক্ষমতার প্রতীক। সঠিক প্রস্তুতি ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে এই উত্তরণকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা সম্ভব।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাছির হোসেন জানান, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া নতুন সংকট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপ। এ অবস্থায় আগামী বছর বাংলাদেশ এলডিসি দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে এলডিসি দেশ হিসেবে এতদিন যেসব দেশে পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া গেছে তা কমে আসবে। এই সংকট উত্তরণে এখনই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।

এমএএস/এএমএ/জিকেএস