চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৬ সেবায় বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকর
চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৬ সেবায় নতুন বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকর করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে এ ট্যারিফ কার্যকর হয়।
এর আগে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকরের কথা থাকলেও নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের নির্দেশে এক মাস বিলম্বে ১৫ অক্টোবর থেকে এ ট্যারিফ কার্যকর করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
তবে ব্যবসায়ীদের আপত্তি উপেক্ষা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। বর্ধিত ট্যারিফ প্ল্যান অনুযায়ী, ৫৬টি সেবার বিপরীতে গড়ে মাশুল বাড়ছে প্রায় ৪১ শতাংশ। যদিও টাগ বোট সার্ভিস, পাইলট চার্জসহ কিছু কিছু সেবায় মাশুল বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ থেকে চার গুণ।
নির্মাণ, আমদানি-রপ্তানি ও শিপিং ব্যবসায়ীরা জানান, এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি সিএমএ-সিজিএম চার্জ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। ফলে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে খরচ বেড়ে যাবে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর চাপবে। নতুন মাশুল স্থগিত রেখে বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনার পর মাশুল নির্ধারণের দাবি তাদের। বিদেশি অপারেটরদের লাভের জন্য মাশুল বাড়ানো হচ্ছে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। এ সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী হবে বলে মনে করেন তারা। এতে রপ্তানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমবে এবং সার্বিকভাবে দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কীসে কত মাশুল
ঘোষিত গেজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, পণ্যভর্তি প্রতি টিইইউস (২০ ফুট একক) কনটেইনারে বর্তমানে গড়ে মাশুল দিতে হবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা, যা আগে গড়ে ছিল কনটেইনারপ্রতি ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। নতুন ট্যারিফ রেট অনুযায়ী, কনটেইনার ওঠানো-নামানোতে চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৮ ডলার, যা আগে ছিল ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার।
পাশাপাশি জাহাজের পাইলটিং চার্জ বিদ্যমান মাশুলে ৩৫৭ ডলার হলেও নতুন মাশুলে রাখা হয়েছে ৮শ ডলার। প্রতি টিইইউ (২০ ফুট) কনটেইনারের জন্য গ্যান্ট্রি ক্রেন চার্জ ধরা হয়েছে ২০ দশমিক ৮০ ডলার, যা আগে ছিল ১৫ ডলার।
আরও পড়ুন:
চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে খরচ বাড়লো ৪১ শতাংশ, আজ থেকে কার্যকর
সেবার মান উন্নয়নেই চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক বৃদ্ধি
চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানিতে বাড়ছে ৩০ শতাংশ শুল্ক
কনভেনশনাল কার্গোর রিভার ডিউজ চার্জ আমদানি কার্গোর ক্ষেত্রে প্রতি টনে শূন্য দশমিক ৪৪৩ ডলার, ডমেস্টিক কার্গোর ক্ষেত্রে প্রতি টনে শূন্য দশমিক ১২৮ ডলার মাশুল নির্ধারণ করা হয়। কনভেনশনাল কার্গোর ওয়্যারফেজ চার্জ (ল্যান্ডিং/শিপিং) ব্যাগড কার্গোর ক্ষেত্রে প্রতি টনে শূন্য দশমিক ৯৬৪ ডলার, সব ধরনের বাল্ক কার্গোর ক্ষেত্রে টনপ্রতি ১ দশমিক ৫৩২ ডলার, ব্রেক বাল্ক এবং অন্য কার্গোর ক্ষেত্রে তিন টনের নিচে টনপ্রতি ১ দশমিক ৩৯৩ ডলার, তিন থেকে ২০ টনে টনপ্রতি ২ দশমিক ৬১০ ডলার এবং ২০ টনের ওপরে টনপ্রতি ৩ দশমিক ৬২৬ ডলার নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি আমদানি কার্গোতে গম ও চালের ক্ষেত্রে ব্যাকড কার্গোর ঘোষিত চার্জের সঙ্গে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত এবং শাটআউট কার্গোর ক্ষেত্রে টনপ্রতি শূন্য দশমিক ৯৮২ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে।
কনভেনশনাল কার্গোর এক্সট্রা হ্যান্ডলিং চার্জ (হোস্টিং) আমদানি কার্গোতে ব্যাগড কার্গোর ক্ষেত্রে প্রতি টনে শূন্য দশমিক ৯৬৪ ডলার, সব ধরনের বাল্ক কার্গোর ক্ষেত্রে টনপ্রতি ১ দশমিক ৫৩২ ডলার, ব্রেক বাল্ক এবং অন্য কার্গোর ক্ষেত্রে তিন টনের নিচে টনপ্রতি ১ দশমিক ৩৯৩ ডলার, তিন থেকে ২০ টনে টনপ্রতি ২ দশমিক ৬১০ এবং ২০ টনের ওপরে টনপ্রতি ৩ দশমিক ৬২৬ ডলার নির্ধারণ করা হয়।
কনভেনশনাল কার্গোর স্টোরেজ চার্জ (ওয়ার্প রেন্ট) আমদানি কার্গোতে কমন ল্যান্ডিংয়ের দিন থেকে লোড ট্রান্সপোর্ট ডেলিভারি পর্যন্ত চারদিন ফ্রি, ট্রান্সশিপমেন্ট/রি-শিপমেন্ট কার্গোর ক্ষেত্রে ইমপোর্টিং ভ্যাসেল থেকে কমন ল্যান্ডিং করা থেকে এক্সপোর্টিং ভ্যাসেলের লোডিং পর্যন্ত ১০ দিন ফ্রি, রপ্তানি কার্গোর ক্ষেত্রে বন্দরে কার্গো গ্রহণ থেকে নির্ধারিত জাহাজে জাহাজীকরণ পর্যন্ত ছয়দিন ফ্রি টাইম রাখা হয়েছে।
এরপর ব্যাগড কার্গোতে ফ্রি টাইমের পরের সাতদিন পর্যন্ত প্রতি টনে দৈনিক শূন্য দশমিক ১৮২ ডলার, অষ্টম দিন থেকে ২০তম দিন পর্যন্ত টনপ্রতি দৈনিক শূন্য দশমিক ৫৪৬ ডলার এবং ২১তম দিন থেকে টনপ্রতি দৈনিক শূন্য দশমিক ৭২৮ ডলার ওয়ার্প রেন্ট নির্ধারণ করা হয়।
পাশাপাশি বাল্ক কার্গোতে ফ্রি টাইমের পরের সাতদিন পর্যন্ত প্রতি টনে দৈনিক শূন্য দশমিক ৩১০ ডলার, অষ্টম দিন থেকে ২০তম দিন পর্যন্ত টনপ্রতি দৈনিক শূন্য দশমিক ৯৩০ ডলার এবং ২১তম দিন থেকে টনপ্রতি দৈনিক ১ দশমিক ২৪০ ডলার ওয়ার্প রেন্ট নির্ধারণ করা হয়।
অন্য কার্গোর ক্ষেত্রে ফ্রি টাইমের পরের সাতদিন পর্যন্ত প্রতি টনে দৈনিক শূন্য দশমিক ৬১৯ ডলার, অষ্টম দিন থেকে ২০তম দিন পর্যন্ত টনপ্রতি দৈনিক ১ দশমিক ৮৫৭ ডলার এবং ২১তম দিন থেকে টনপ্রতি দৈনিক ২ দশমিক ৪৭৬ ডলার ওয়ার্প রেন্ট নির্ধারণ করা হয়।
যা বলছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা
বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে চট্টগ্রামের অন্যতম ব্যবসায়ী সিকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক জাগো নিউজকে বলেন, বন্দরসহ সব ক্ষেত্রে মাশুল ও অন্যান্য খরচের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের জন্য চরম সমস্যার কারণ। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে মাশুল কার্যকর করা দুঃখজনক।
আমিরুল হক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখন ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করে বন্দর কেন মাশুল বাড়াচ্ছে সে দায় বন্দরকে নিতে হবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, বন্দর ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে শিপিং কোম্পানিরাও তাদের চার্জ সমন্বয় করছে। মেইন লাইন অপারেটররা তাদের চার্জ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। নতুন ট্যারিফের কারণে জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়া প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়বে। যা আমদানি-রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে আদায় করা হবে।
আরও পড়ুন
বন্দর মাশুল বাড়ায় দাম বাড়বে খাদ্যপণ্যের
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলবে বাড়তি বন্দর মাশুল
চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন মাশুল কার্যকর, রপ্তানিতে চাপের শঙ্কা
বাংলাদেশে গমের বড় আমদানিকারক নাবিল গ্রুপ। চট্টগ্রাম ও ঢাকার পাইকারি বাজারের মাধ্যমে তারা সারাদেশে গম সরবরাহ করে।
নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোয় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে কনটেইনারবাহিত পণ্যে। যেহেতু বন্দরের সবগুলো সেবায় মাশুল বাড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে বাল্কপণ্য আমদানিতে যে ব্যয় বাড়বে, তা শেষে ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়বে। এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। পণ্যের আমদানি খরচ বাড়লে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে।’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল কবীর সুজন বলেন, ‘বন্দরের উচিত এত বেশি মাশুল বাড়ানো থেকে বিরত থাকা। ট্যারিফ বেশি হওয়ায় কনটেইনার ও জাহাজ ভাড়া বাড়ছে। এতে আমদানি খরচ বাড়বে। ফলে পরিবাহিত পণ্যের দামও বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘বন্দর ব্যবহারকারীদের নিয়ে যে আলোচনা চলছিল, তাতে আমরা বলেছিলাম মাশুল একেবারেই যদি বাড়াতে হয় তাহলে ১০-১৫ শতাংশের বেশি যাতে বাড়ানো না হয়। আমরা গেজেট পেয়েছি, তাতে দেখেছি, সব ধরনের সেবায় গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশিও বাড়ানো হয়েছে। যতই বাড়ানো হোক, পণ্য আমদানির বর্ধিত ব্যয় ব্যবসায়ীরা ভোক্তার কাছ থেকেই আদায় করবে। শেষমেশ বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে গিয়ে পড়বে।’
আমদানি করা রসুন, আদা, ফল ও মাছ-মাংস আসে রেফার কনটেইনারে। নতুন ট্যারিফে রেফার কনটেইনারের ক্ষেত্রেও মাশুল বেড়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ তৌহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে ফলের দাম বাড়তি। বন্দরে নতুন করে শুল্ক বাড়ানোর কারণে আমদানি করা ফলসহ রেফার কনটেইনারে আমদানি করা সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে।’
বন্দরের মাশুল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শিপিং এজেন্টগুলোও বর্ধিত চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান।
তবে বন্দর মাশুল বাড়ানোর প্রভাব ভোক্তাপর্যায়ে পড়বে না বলে মনে করেন বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘আমরা বর্ধিত নতুন মাশুল পর্যালোচনা করে দেখেছি, আমাদের বাল্কপণ্যে বিদ্যমান রেটে প্রতি কেজিতে ৩২ পয়সা খরচ পড়ছে। বর্ধিত ট্যারিফ রেট অনুযায়ী তা কেজিপ্রতি ৪৪ পয়সা খরচ হবে। প্রতি কেজিতে মাত্র ১২ পয়সা খরচ বাড়বে। এতে আমাদের মনে হয় ভোক্তাদের এই ১২ পয়সা বেশি দেওয়া কোনো বিষয় নয়।’
এমডিআইএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/এএসএম