‘কলমের খোঁচায়’ বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ দরকার
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন
‘দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটাতে ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে যা ‘কলমের খোঁচায়’ বাস্তবায়নযোগ্য। অর্থাৎ, স্বল্পমেয়াদি ও দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য। এটা যদি করা যায়, তাহলে বিনিয়োগে যে স্থবিরতা চলছে তা কিছুটা হলেও কেটে যাবে।’
জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ মন্তব্য করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইব্রাহীম হুসাইন অভি।
ড. জাহিদ আরও বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে শুধু বড় সংস্কার নয়, বরং ছোট ছোট নীতিগত পরিবর্তন এবং প্রশাসনিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করাটাও জরুরি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা ও নীতি বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা থাকলে বাংলাদেশ আবারও আস্থা অর্জন করতে পারবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
কেউ একজন বলেছিলেন—প্রশাসনের কাজই নাকি কিছু করতে না দেওয়া! এই মনোভাব বদলানো জরুরি। কমিশন, অথরিটি, বা যে কোনো রেগুলেটরি বডির কার্যকারিতা তখনই নিশ্চিত হবে, যখন তাদের সুপারিশ কার্যকর হবে এবং বাস্তবায়নের গতি থাকবে। এখন শুনছি ফেব্রুয়ারির আগেই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে—দেখা যাক কতটা কার্যকর হয়
বর্তমানে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ও অর্থনীতির অবস্থা কেমন দেখছেন?
বর্তমানে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল বলা যায়। তবে সম্প্রতি ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যেখানে তারা কয়েকটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের কথা বলেছে—দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতের সীমাবদ্ধতা, ও ট্যাক্স ব্যবস্থার অসংগতি।
আরও পড়ুন
সংস্কারের ফল পেতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে হবে
ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে আইনশৃঙ্খলার দৃশ্যমান উন্নতি জরুরি
রপ্তানির ৭০ শতাংশ আয় ১০ দেশ থেকেই, বাড়ছে ঝুঁকি
আপনার দৃষ্টিতে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এখন আমাদের কোন ধরনের পদক্ষেপ এ ফোকাস করা উচিত?
প্রশ্নটা কঠিন, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। বড় ধরনের সংস্কার করতে গেলেই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিরোধ দেখা দেয়। কে সংস্কার করবে, নির্বাচিত কি না—এ ধরনের নৈতিক ও আইনগত প্রশ্ন উঠে আসে। তবে আমার মনে হয়, সরকার বর্তমানে এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে যা ‘কলমের খোঁচায়’ বাস্তবায়নযোগ্য। অর্থাৎ, স্বল্পমেয়াদি ও দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য। এটা যদি করা যায়, তাহলে বিনিয়োগে যে স্থবিরতা চলছে তা কিছুটা হলেও কেটে যাবে।
বড় সংস্কার না করেও কি স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব?
অবশ্যই। যতদিন না বড় কাঠামোগত পরিবর্তন হয়, ততদিন এ ধরনের ছোট কার্যকর পদক্ষেপগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। এগুলোই ভবিষ্যতের বড় সংস্কারের ভিত্তি তৈরি করবে।
সংস্কার কী ব্যবসায়ীদের উপকারে আসছে?
বেশ কিছু উদ্যোগ ব্যবসায়ীদের উপকারে আসছে এবং আরও আসবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-
এইচএস কোড সংস্কার: ইমপোর্ট ডকুমেন্টে একটি ডিজিট না মিললে আগের মতো পুরো প্রক্রিয়া আটকে যেত। এখন সেটা শিথিল করা হয়েছে।
বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা: যাদের বন্ড সুবিধা ছিল না, তারা এখন ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে ডিউটি ফ্রি আমদানি করতে পারছে, যা এক্সপোর্ট খাতের জন্য বড় সুবিধা।
ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডোর গতি: লাইসেন্স নবায়ন বা নতুন ইস্যুতে আগের মতো দীর্ঘসূত্রতা নেই—গত দুই মাসে পাঁচ লাখ লাইসেন্স ইস্যু হয়েছে।
প্রকিউরমেন্ট রুল সংস্কার: বিড প্রাইসের ±১০ শতাংশ সীমা ছিল, যা অনেকে আগেই জেনে নিয়ে কৌশলে কন্ট্রাক্ট জিততো। এখন সেটা ট্রান্সপারেন্ট করা হয়েছে, প্রতিযোগিতা বাড়বে।
এর বাইরেও ব্যাংক মার্জার রিফর্ম ও এনবিআর পৃথকীকরণ দুটি উল্লেখযোগ্য বৃহৎ রিফর্ম এখন প্রক্রিয়াধীন। যদিও পুশব্যাক এসেছে, তারপরেও সরকার দৃঢ় অবস্থানে আছে।
এগুলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়াতে এই মুহূর্তে কী করা উচিত, যাতে বিনিয়োগকারীরা এখনই যেন কিছু সুবিধা পান?
‘দেখুন, দুর্নীতি বা আমলাতন্ত্র একদিনে যাবে না। কিন্তু কিছু ইনক্রিমেন্টাল রিফর্ম যেগুলো এখনই করা সম্ভব—তাতে বিনিয়োগ ফিরে আসবে। যেমন, রেগুলেটরি ক্লিয়ারেন্স সহজ করা, ডলার রিলিজ ফাস্ট ট্র্যাক করা ও ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকদের এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটায় আরও সুবিধা দেওয়া—এই ছোট ছোট পদক্ষেপ বড় প্রভাব ফেলবে।
দুর্নীতি বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগের পথে বড় বাধা। এটা কীভাবে কমানো যায়?
দুর্নীতির কথায় যদি আসি, সেখানে ফাইল ‘চলে’ কখন? যখন ঘুস চলে। ফাইল টেবিলে বসে থাকে, কারণ কেউ চায় না কাজ এগোতে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইলে শুধু প্রশাসনিক নয়, অ্যাকাউন্টেবিলিটি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা লাগবে, যা বড় রকমের আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়।
সংস্কারে এত প্রতিরোধ আসছে কেন?
কারণ যেসব প্রভাবশালী মহল সুবিধা পায়, তারা চায় না যে পরিবর্তন হোক। যেমন—ফাইল টেবিলে আটকে থাকে, কারণ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করায়। এতে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। কেউ আবার রাজনৈতিক শক্তি কাজে লাগিয়েও সুবিধা নিতে পারে।
আপনি কি মনে করেন যে প্রশাসনের একটা বড় অংশ সংস্কারের পক্ষে নয়, এরা অনেক সময় কাজ আটকে রাখে?
ঠিক বলেছেন। কেউ একজন বলেছিলেন—প্রশাসনের কাজই নাকি কিছু করতে না দেওয়া! এই মনোভাব বদলানো জরুরি। কমিশন, অথরিটি, বা যে কোনো রেগুলেটরি বডির কার্যকারিতা তখনই নিশ্চিত হবে, যখন তাদের সুপারিশ কার্যকর হবে এবং বাস্তবায়নের গতি থাকবে। এখন শুনছি ফেব্রুয়ারির আগেই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে—দেখা যাক কতটা কার্যকর হয়।
যদি এখনকার সরকার কিছু কার্যকর রিফর্ম রেখে যেতে পারে, তাহলে নতুন সরকার এসে বড় সংস্কার হাতে নিতে পারবে। তবে এসব কিছুই নির্ভর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার ওপর।
আইএইচও/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস