শিক্ষক সংকট চরমে, বিশেষ বিসিএস নাকি পদ বাড়িয়ে সমন্বয়?

• ৬৬৩ সরকারি কলেজে ২৫ শতাংশ শিক্ষক পদ শূন্য
• নতুন শিক্ষক পদসৃজনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চাপ’
• ৪৪-৪৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে পদ বাড়ানোর চিন্তা
• ‘টেকসই’ সমাধানে প্রয়োজনে ৪৯তম বিশেষ বিসিএস
দেশের স্নাতক পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোতে গড়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষক পদ শূন্য। এসব কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। অবসর, চাকরিচ্যুতি, পদত্যাগ, মৃত্যুসহ নানা কারণে কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট প্রকট। আবার শিক্ষার্থী বাড়লেও ২০-২৫ বছরেও অনেক কলেজে নতুন করে শিক্ষক পদসৃজন হয়নি।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
ফলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হারও হতাশাজনক। কোথাও কোথাও ২০০ থেকে ২৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতেও একজন শিক্ষক নেই। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। শূন্যপদ ও সংকট কাটাতে শিক্ষক নিয়োগে অন্তর্বর্তী রকারকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
পরিস্থিতি বিবেচনায় সংকট কাটাতে বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডার নিয়োগের পরিকল্পনা করে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে চিকিৎসক সংকট কাটাতে স্বাস্থ্য ক্যাডার নিয়োগেও বিশেষ বিসিএসের চিন্তা করা হয়। চিকিৎসক ও শিক্ষক নিয়োগে একটি বিশেষ বিসিএসের জন্য সরকারি কর্ম কমিশনকে (পিএসসি) সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
যেখানে শিক্ষক নেই সেখানে শিক্ষা কোথা থেকে আসবে? আমরা দিকহারা জাহাজের যাত্রী। কেন যে এ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, তা ভেবে দিশা পাই না। ক্লাসে শিক্ষক আসেন না। থিওরি হয়তো মুখস্ত করে ফেলি। কিন্তু সিলেবাসে যত ম্যাথ (গণিত) আছে, সেগুলো কে শেখাবে?- শিক্ষার্থী রিয়াদুল ইসলাম ফাহাদ
তবে প্রস্তুতি শেষে বৃহস্পতিবার (২৯ মে) তিন হাজার চিকিৎসক নিয়োগে ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পিএসসি। আগামী জুলাইয়ে এমসিকিউ পদ্ধতিতে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই এ বিসিএসের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে—শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষা ক্যাডারের জন্য বিশেষ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হবে কবে?
পিএসসি কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষা ক্যাডারের জন্যও বিশেষ বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। তবে দ্রুততম সময়ে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বিষয়ভিত্তিক সিলেবাস তৈরি, পরীক্ষা নিতে বেশ লম্বা সময়ের প্রয়োজন। ফলে বিশেষ বিসিএস এড়িয়ে ভিন্ন চিন্তা করছে পিএসসি। সরকার পিএসসির সেই ভিন্ন পরিকল্পনায় সায় দিলে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করে শিক্ষক সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
সরকার তথা জনপ্রশাসন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা পিএসসি কীভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেবে, সেটা তাদের প্রক্রিয়া। আমাদের জরুরিভিত্তিতে শিক্ষক প্রয়োজন। সেটা আমরা জানিয়েছি, ভবিষ্যতেও বারবার স্মরণ করিয়ে দেবো।- অধ্যাপক ড. এস এম আমানুল্লাহ
শিক্ষা ক্যাডারে শূন্যতা, ব্যাহত শিক্ষা কার্যক্রম
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পটিয়া সরকারি কলেজ। ৪৪ বছর আগে কলেজটি সরকারিকরণ হয়। বর্তমানে কলেজের সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষক সংকট। প্রতিষ্ঠানটিতে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ৪৯ জন। অর্থাৎ, প্রতি ২০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক মাত্র একজন।
- আরও পড়ুন
- বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে বয়সসীমা থাকছে না
- চিকিৎসক নিয়োগে ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, শূন্যপদ ৩০০০
- বিশেষ বিসিএসের জন্য পিএসসির বিধিমালা সংশোধন, প্রজ্ঞাপন জারি
শুধু পটিয়া সরকারি কলেজ নয়, দেশের ৬৬৩টি সরকারি কলেজে শিক্ষক সংকট রয়েছে। কোথাও যতটি পদ আছে, ততজন শিক্ষক নেই। আবার কোথাও দীর্ঘদিন পদ সৃষ্টি না হওয়ায় স্বল্প শিক্ষক নিয়ে কোনোমতে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে ক্লাসে আসছেন না শিক্ষার্থীরা।
পিএসসি সূত্র জানায়, শিক্ষা ক্যাডারে বিশেষ বিসিএসের জন্য শূন্যপদের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ তথ্য সংগ্রহ করে পিএসসিতে পাঠিয়েছে। সবশেষ চিঠিতে দেশের সরকারি কলেজগুলোতে ৬৮৩ জন প্রভাষক নিয়োগের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। সব তথ্য এখনো না আসায় এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞাপন
শিক্ষক সংকটের বিষয়টি আমরা অবগত। পিএসসি এটা নিয়ে কাজ করছে। এখন বিশেষ বিসিএস হবে নাকি পদ বাড়ানো হবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা প্রাথমিক কিছু আলোচনা করেছি। সেটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবগত করবো। সরকার অনুমোদন দিলে সেভাবে এগোবে পিএসসি।- অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম
এদিকে, শিক্ষক সংকটকে দেশের কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার মান নিশ্চিতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংকও। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত অনেক বেশি। এমনকি যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তাদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছিল। এরপরও ছয় বছর পেরিয়েছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত আরও বেড়েছে। শিক্ষার মান হয়েছে নিম্নমুখী।
রাজধানীর সরকারি বাঙলা কলেজে শিক্ষক সংকট চরমে। এখানেও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। কলেজের সব বিভাগেই শিক্ষক কম। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে সেটি আরও বেশি।
বিজ্ঞাপন
বাঙলা কলেজের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াদুল ইসলাম ফাহাদ বলেন, ‘যেখানে শিক্ষক নেই সেখানে শিক্ষা কোথা থেকে আসবে? আমরা দিকহারা জাহাজের যাত্রী। কেন যে এ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, তা ভেবে দিশা পাই না। ক্লাসে শিক্ষক আসেন না। থিওরি হয়তো মুখস্ত করে ফেলি। কিন্তু সিলেবাসে যত ম্যাথ (গণিত) আছে, সেগুলো কে শেখাবে?’
বিশেষ বিসিএস নাকি পদ বাড়িয়ে সমন্বয়?
শিক্ষা ক্যাডারে এমন শূন্যতা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দিতে চায়। সেক্ষেত্রে বিশেষ বিসিএস নাকি ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা করা হবে; তার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পিএসসিকে দায়িত্ব দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পিএসসি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারে বিশেষ বিসিএস দিতে চেয়েও তা পারেনি। শুধু চিকিৎসক নিয়োগে বিশেষ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
পিএসসির কর্মকর্তারা জানান, পিএসসি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ নিয়ে দুটি চিন্তা করছে। প্রথমটি হলো—৪৪ ও ৪৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে যে পদ আছে, তা কিছুটা বাড়িয়ে শিক্ষক সংকট দূর করা। আর তাতে যদি সংকট না কাটে দ্বিতীয় চিন্তা অর্থাৎ, শিক্ষা ক্যাডারের জন্য আসবে ৪৯তম বিশেষ বিসিএস। চলতি বছরের শেষ দিকে এ বিজ্ঞপ্তি হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
দুটি চিন্তার মধ্যে প্রথমটিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পিএসসির একজন সদস্য। নাম প্রকাশ না করে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষক সংকট আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যায় গতিশীল হতে চাচ্ছে। তারা এখন অনেক শিক্ষক চাচ্ছেন। শূন্যপদ পূরণ তো বটেই, সঙ্গে পদসৃজন করে শিক্ষা ক্যাডারের পদ বাড়ানোর আলোচনাও চলছে। সেক্ষেত্রে শূন্যপদগুলো দ্রুত পূরণে বিশেষ বিসিএসের চেয়ে ৪৪ ও ৪৫তম বিসিএসের দ্রুত ফলাফল দেওয়া এবং সেখানে শিক্ষা ক্যাডারে পদ বাড়ানোটা বেশি যুক্তিযুক্ত।’
- আরও পড়ুন
- সাত কলেজে অন্তর্বর্তী প্রশাসন
- অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় কলেজ অধ্যক্ষ-ইনস্টিটিউট প্রধান নিয়োগ
- প্রাথমিকে ৮ হাজার সহকারী শিক্ষক পদ শূন্য
শিক্ষা ক্যাডারের জন্য বিশেষ বিসিএসের পথে পিএসসি কেন হাঁটতে চাইছে না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারে ৩১-৩২টি বিষয় রয়েছে। সেখানে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা নিতে হলে বিশেষ বিসিএসের জন্য ৩২টি বিষয়ের সিলেবাস ও প্রশ্ন তৈরি করা প্রয়োজন। এটা বেশ সময়সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে শূন্যতা পূরণে যে তড়িঘড়ি, তা মেটানো সম্ভব নয়। বরং ৪৪ ও ৪৫তম বিসিএসে অনেক যোগ্য প্রার্থী রয়েছে। তাদের মধ্য থেকে পদ বাড়িয়ে নিয়োগ দেওয়াটা সহজ। সরকার আমাদের প্রস্তাবে সায় দিলে সেটাই হয়তো করা হবে।’
৪৪-৪৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে পদ কত
২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে মোট পদসংখ্যা ১ হাজার ৭১০টি। এর মধ্যে ৭৭৬টি শিক্ষা ক্যাডার। অন্যদিকে ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল পিএসসি। এ বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। যার মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারে ৪৩৭ জন। অর্থাৎ, দুই বিসিএস মিলিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ১ হাজার ২১৩ জন।
বিজ্ঞাপন
পিএসসি সূত্র জানিয়েছে, ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল জুনের শেষ দিকে হতে পারে। আর ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল জুনের শুরুতে হবে। তারপর মৌখিক পরীক্ষা হবে। শিগগির এ দুটি বিসিএসে চূড়ান্ত সুপারিশ করার চেষ্টা করছে পিএসসি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সূত্র বলছে, ৬৮৩টি শূন্যপদের তথ্য পাওয়া গেলও আরও অন্তত ৫০০ পদ ফাঁকা রয়েছে। নতুন করে পদসৃজনের অনেক আবেদন জমা পড়েছে। তাছাড়া ৪৪ ও ৪৫তম বিসিএসের গেজেট জারি এবং নিয়োগ পাওয়াদের যোগদান করতে করতে আরও বহু পদ ফাঁকা হবে। সেজন্য শিক্ষক সংকট কাটাতে বিশেষ বিসিএসই স্থায়ী সমাধান।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম আমানুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কলেজগুলোতে শিক্ষক জরুরি। আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কাঠামো পাল্টে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছি। সেখানে দক্ষ-যোগ্য ও তরুণ শিক্ষক দরকার। সরকার তথা জনপ্রশাসন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা পিএসসি কীভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেবে, সেটা তাদের প্রক্রিয়া। আমাদের জরুরিভিত্তিতে শিক্ষক প্রয়োজন। সেটা আমরা জানিয়েছি, ভবিষ্যতেও বারবার স্মরণ করিয়ে দেবো।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষক সংকটের বিষয়টি আমরা অবগত। পিএসসি এটা নিয়ে কাজ করছে। এখন বিশেষ বিসিএস হবে নাকি পদ বাড়ানো হবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা প্রাথমিক কিছু আলোচনা করেছি। সেটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবগত করবো। সরকার অনুমোদন দিলে সেভাবে এগোবে পিএসসি।’
এএএইচ/এমকেআর/জিকেএস
বিজ্ঞাপন