চতুরঙ্গ রেজা নুর সংখ্যা: তার সৃষ্টির সামগ্রিক দলিল
মাহমুদ নোমান
ইদানীং এ দেশের লেখকেরা অস্থিরতায় ধরাশায়ী। যেখানে হতাশার সাথে বিরক্তি মিশেছে অনেক। সেটি একদিনে হয়নি। আর্থসামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে বৈষম্যে নিষ্পেষ হতে থাকে একজন লেখক। বেশিরভাগই মনে করেন, লেখকেরা লিখে অর্থ পাবে সেটি বেমানান। এই ফাঁকে পড়ে লেখককে শুধু লিখতে হয়েছে ডানে-বামে না তাকিয়ে; পেটের দায় কিংবা পিঠের দায় দিনশেষে কেউ ভাবেনি। সেটিই হয়েছে বিগত কয়েক যুগে। সব মিলেই একজন লেখক বা কবির মাঝে হাপিত্যেশে একটি জেদ তৈরি হয়। একজন কবি ধৈর্যহারা হয়ে যান। এ কারণেই বিগত কয়েক যুগে আমরা সত্যিকারের কবি পাইনি। এসব বলার জন্য বলা নয়, একজন কবির লেখনী বলতে উৎসাহ জুগিয়েছে। তিনি হলেন কবি রেজা নুর। দীর্ঘসময় বাংলা সাহিত্যে অন্তরাত্মা দিয়ে লিখে যাওয়া এক কবি। এবারের বইমেলায় রেজা নুরকে নিয়ে সাহিত্যের কাগজ ‘চতুরঙ্গ’ অনবদ্য একটি সংখ্যা করেছে। এ লেখার প্রসঙ্গও এটি।
রেজা নুরের যাপিত জীবনের খুঁটিনাটি সম্পর্ক বা বোঝাপড়াও দারুণভাবে উঠে এসেছে এ সংখ্যায়। রেজা নুরকে জানতে ও বুঝতে সমসাময়িক এবং নতুন প্রজন্মের কাছে সংখ্যাটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে নিশ্চিত। এ সংখ্যায় রেজা নুরের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ এমনকি আত্মীয়দের ভিড় থেকেও ব্যক্তি রেজা নুরের বিবিধ গুণগান উল্লিখিত হয়েছে। রেজা নুরের সাথে কয়েকটি সাক্ষাৎকারও সন্নিবেশিত হয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত বিষয়বৈচিত্র্য উত্থাপনে। তবে রেজা নুরকে কবি বলেই আমার আনন্দ বেশি। কেননা তার কবিতায় কিংবা কবিতা যাপন ও চর্চায় উপরোল্লিখিত লেখক বা কবির মাঝে যে হাপিত্যেশের কথা বলেছি; সেটি অনুপস্থিত। নিজের আনন্দে ও গরজে নিজেরই কবিতা লেখেন। দেখিয়ে দেওয়ার কিংবা কারও মন জুগিয়ে কবিতা লেখার বাতিক নেই কবি রেজা নুরের কবিতায়।
কবি রেজা নুর কবি হিসেবে দেশসেরা কিংবা প্রতিনিধিত্ব করা কবি বলাটা জরুরি নয়, বরঞ্চ তার কবিতার চলন-বলন রেজা নুরকে প্রতিনিধিত্ব করে এটাই উল্লেখ্য। প্রত্যেক কবির মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাত টানাপোড়েন অবশ্যই থাকে। যাপিত জীবনে ভালো যা কিছু ঘটেছে সেসব জাহির করে। যেসব জীবনের জন্য ভালো হয়নি মনে করে; সেসব আড়াল করে। অথচ সেসব আড়ালই একজন কবির কবিতা। আজকের রেজা নুরকে যা দেখছি, সেই অবস্থানে আসতে কী আকুতিভরা বোধবিজ্ঞানে জ্বলন পীড়ন সেসব রেজা নুরের কবিতা। এসব কথা বলার কারণ এখনকার রেজা নুরকে দিয়ে তার কবিতার যাত্রা নিরূপিত করা যাবে না। অর্থাৎ জনপ্রিয়তার প্রতি নির্মোহ ভাবনা আর নিজের লেখার প্রতি একাগ্রতা রেজা নুর এখনকার বাংলা সাহিত্যে একজন ব্যতিক্রমী কাব্য প্রতিভা। ওই যে বললাম, তিনি একদিনে রেজা নুর হননি, সেটিই চতুরঙ্গ-এর ‘একজন রেজা নুর’ সংখ্যাটি পাঠ করলে বুঝতে সক্ষম হবেন।
০২
‘চতুরঙ্গ’ সাহিত্যের কাগজটির সম্পাদক জব্বার আল নাঈম। তিনিও একজন কবি ও কথাসাহিত্যিক। ‘একজন রেজা নুর’ সংখ্যাটি চতুরঙ্গ-এর চতুর্থ বর্ষের প্রথম সংখ্যা। একজন রেজা নুর ও তার সামগ্রিক কর্মকে ‘চন্দন বনের ঐশ্বর্য’ আখ্যা দিয়ে চমৎকার একটি দরদী কর্মযজ্ঞ উপস্থাপন চতুরঙ্গ-এর। জব্বার আল নাঈমের সাথে কবি রেজা নুরের সাথে আন্তরিক সম্পর্কই হয়তো এরকম একটা কাজ করতে চমৎকার উৎসাহ জুগিয়েছে।
শুরুতে জব্বার আল নাঈমের প্রায় ১০ পৃষ্ঠার ভূমিকায় রেজা নুরের যাপিত জীবন ও চতুরঙ্গ-এর ‘একজন রেজা নুর’ সংখ্যার সবটুকুর মূল্যায়ন করেছে সহজাত চতুরতায়। ভূমিকাটি পড়লেই সংখ্যাটিতে কী কী আর কীরকম লেখা আছে সহজে অনুমেয় হবে পাঠকের কাছে। ভূমিকার পরে ব্যক্তি ও সাহিত্যিক রেজা নুরকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করা হয়েছে। এরপরে মুখোমুখি বিভাগে রেজা নুরের দুটো লেখা। যেখানে ছন্দের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধির ব্যাখ্যা ও ‘কবিদের মূল্যায়ন জীবিত অবস্থায় হতে দেখা যায় কম’ শিরোনামে নিজের অভিজ্ঞতার আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন। পাঠকদের কাছে আলাদা আবেদন তৈরি করবে লেখা দুটি।
কবিতা পর্যালোচনার বিভাগটি বেশ বড় পরিসরে দেশের অনেক নামকরা কবিদের অসামান্য লেখায় সন্নিবেশিত হয়েছে। এ বিভাগে ফিরোজ আশরাফ, মুম রহমান, ড. নাজমুল হাবিব, আজিম হিয়া ও কাজী শোয়েব শাবাবের লেখা উল্লেখযোগ্য। গল্পের পর্যালোচনায় ছিলেন মোজাফফর হোসেন, রেজোয়ান ফেরদৌস, রাসেল আবদুর রহমান ও শিবলী আহমেদসহ অনেকে।
উপন্যাস পর্যালোচনায় মনি হায়দার, কামরুল আহসান, জোবায়ের মিলন, রাকিবুল রকির লেখা বেশ ভালো লেগেছে। উপন্যাসে রেজা নুরের ভাষার সরলতায় আন্তরিক বুনন আলোচকদের লেখায় বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে। সামগ্রিক আলোচনায় ছিলেন স্বপ্না গুহ ঠাকুরতা, শামস সাইদ, প্রজ্ঞা মৌসুমীর মতো লেখকের লেখাও। আবদুল মমিন ও ড. মাহমুদ হাবিবের আলোচনায় উঠে এসেছে রেজা নুরের অনুবাদ কবিতার ভুবন। সবশেষে সংযুক্ত হয়েছে রেজা নুরের নির্বাচিত গল্প ও কবিতা।
৩৮৪ পৃষ্ঠার বৃহৎ কলেবরের সংখ্যাটি একজন রেজা নুরকে জানার জন্য যথেষ্ট। একজন কবি বা লেখকের জীবনে এটি অনেক বড় প্রাপ্তিও বটে। রেজা নুরও স্বাভাবিক নিয়মে ইহজগত পার করে যাবেন। তবে তার কর্ম-চরিত্র পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যথাযথ উপস্থাপনে প্রকাশ করেছে।
ছোটকাগজ: চতুরঙ্গ
সংখ্যা: একজন রেজা নুর
সম্পাদক: জব্বার আল নাঈম
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ৫০০ টাকা।
এসইউ/জেআইএম