বই পর্যালোচনা
জলের ফুল: নির্ভেজাল আকুতিভরা কবিতা
স্মার্ট শব্দগুচ্ছে ভেতর বাহির স্পন্দিত করে সহজাত উপমার সারল্যে, চিত্রিত ভাবকল্পে পর্দা টেনে দেখিয়ে দেয় অকৃত্রিম সৌন্দর্য বোধের জগতটাকে, নির্ভেজাল আকুতিভরা এমনও বোধবিজ্ঞানের স্মারকলিপি রাজ মাসুদ ফরহাদের কবিতা। সম্প্রতি এই কবির ‘জলের ফুল’ পাঠ করার মাধ্যমে পেয়ে যাই কবিতার মার্জিত রূপরেখার উপর্যুপরি চেতনার স্ফূর্তির সুরারোপ, পেয়ে গেছি সত্য উদ্ঘাটনের কলাকৌশলে কবির কথা বলা কেমন টেনে নিয়ে যেতে পারে গহীনে, এক মুহূর্তে! এই বুঝি কবির গায়েবি শক্তি, অল্প কথায় অনেক কিছু বলে দিতে পারার কবিতা রাজ মাসুদ ফরহাদের—
প্রতিটি ট্রেন ফুঁকতে ফুঁকতে হুইসেল
এগিয়ে আসে;
হাতে নিয়ে লাল-সবুজ পতাকা
দাঁড়িয়ে যায় মনু
ঝিকঝিক চলে যায়
থামে না ট্রেন কোনোকাল!
বাড়িতে তার ধিকিধিকি জ্বলে চুলো;
কলমিলতা আর পুঁইশাকের জীবন
চেয়ে থাকে অপলক
ট্রেন থেকে নেমে আসবেন রাজা;
হাঁড়িতে হবে রান্না
পোলাও লাল মাংস!
(স্টেশন, পৃষ্ঠা-৯)
বলার মেজাজে বাড়তি কিছু নেই, গ্রামীণ জনজীবন ও মেঠোপথ বুকে নিয়ে সম্মোহনী রেখা রাজ মাসুদ ফরহাদের কবিতা; ভাষা নিয়েও টানাহেঁচড়া কিংবা নিরীক্ষার নামে হা-হুতাশ নেই, নিজের মনের আনন্দে লিখে যান; এই যেন একার সন্ন্যাস, কেবলই এই কবি সমাজে খারিজি সাহিত্যে অন্তত রাজ মাসুদ ফরহাদ আশির্বাদপুষ্ট একজন কবি; নিজের মায়ের আশপাশ লিখে যাওয়ার কবি।
০২.
কবিতা কী, কেন লিখছি এসব প্রশ্ন আমাকে সজ্ঞানে জড়িয়ে থাকে। এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে বলে দিতে পারি না কবিতাকে জানি, এজন্যই লিখছি এমন কথাকলি! কখনো মেজাজ বিগড়িয়ে বলতে পারি না কবিতাকে লিখবো না, এসবের আগে বলি নিজেকে—কবিতা কেন লিখবো না? কবিতা না লিখলে কবিতার কি কোনো ক্ষতি হবে? কবিতা কখনো বলে না কবিতাকে লিখতে। তাহলে কাকে বলি আমরা কবিতা লিখবো না!
এটি সম্পূর্ণ অলিখিত রহস্য। অনির্ণীত গুহা, কয়েকটা ফোঁটার অনন্ত পারাপার। আমি বলি হৃদয়ানুভূতিসম্পন্ন প্রত্যেকে কবি। অর্থাৎ ভেতরটা যখন বলে ‘ক(ই)বি’। এই একটা তাড়না আসে মানুষ থেকে, সমাজ থেকে, প্রকৃতি থেকে, বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস থেকে; আজকালকার কবিতায় অতি মেকাপ, অতি অলংকরণে কিংবা নিরীক্ষার নামে চালিয়ে দেওয়া বাড়াবাড়ি রাজ মাসুদ ফরহাদের কবিতাকে ছুঁতে পারেনি অথবা ওইসবে লাফালাফি নিজস্বতাকে বিনষ্ট করে কবি রাজ মাসুদ ফরহাদ হয়তো বুঝতে পেরেছেন—
পৃথিবী
ঘুমিয়ে আছে—
হাত-মুখ ধুয়ে আগামীকাল সূর্যের সামনে এসে দাঁড়াবে
পাশে বসে বলবে, চলো মেঘের কাছে বর্ষণেট গল্প বলে আসি
সূর্য,
কী করে বুঝবে মেঘের বোবা গর্জন
দেখবে কতটা জল জমে আছে বুকের ভিতর
আগামীকাল ভোরের যোনিতে জন্ম দেবে
সূর্য
পৃথিবী
আগামীকাল রাতের গর্ভে ঘুমিয়ে পড়বে
পৃথিবী
সূর্য
(পৃথিবী ও সূর্য, পৃষ্ঠা-১০)
খ.
কী করে ভুলে থাকি হেরা গুহায়
জন্ম নেয়া জীবনপাঠ
চোখের নিদান...
এ কেমন তোমার বাজুকরি
ডেকেছ কুরআনে নীলাম্বরি
পড়ে থাকি জায়নামাজে
ডেকে যাই পাঁচওয়াক্ত তোমারে
বুঝি না কিছু আর
শুধু তুমি ছাড়া
সকাল বিকেল হুঁশহারা
দেহের মাঝে নেই আমি
তোমার মাঝে অপার হয়ে থাকি
(অপার, পৃষ্ঠা-১৪)
গ.
ক্যারামের ঘুঁটির মতো একটি বেদনাহত মাছি
খাচ্ছে পাক সন্ধ্যার পথে
আমি—তবু নতজানু হয়ে আছি এ-খেলায়
পরাজিত হতে হতে শিখে যাই জয়ের বর্ণমালা
(জয়ের বর্ণমালা, পৃষ্ঠা-৩৯)
০৩.
রাজ মাসুদ ফরহাদ দ্রোহে সর্বদাই তেজোবান, ভালোবাসার চেতনায় উদ্দীপিত কাঙাল, যার খোলস যতই কঠিন মনে হোক, ভেতরটা তুলতুলে নরম, এই বুঝি সুফি তাত্ত্বিক মরমিয়া কবি; তবে অন্যায় আবদারে গলে যাওয়া মোম নয়, সদা জাগরুক অনল রাজ মাসুদ ফরহাদের কবিতা। দেশ মাতৃকার প্রশ্নে একজন আপোসহীন অকুতোভয় সংগ্রামে সাহসী মর্মব্যথক, জীবনকে দেখার মধ্যে রোমান্টিকতা সপাটে আঘাত হানতে পারে অন্তর্লীনে, সহজেই ছড়িয়ে দিতে পারেন ধ্রুপদী সৃষ্টি—
আজ মেলাবার দিন/ সাবান ও শ্যাম্পুর মিলনে/ শব্দ ও নৈশব্দ পাশাপাশি/ ব্লেডে কেটে যাওয়া গাল;
(দোঁহে, পৃষ্ঠা-৪৩)
কিংবা
...মুখের ওপর সৃতন
কে যেন বাতাসে
জ্বেলে দিয়েছে কেরোসিন
(ফুলের গান, পৃষ্ঠা-২৭)
রাজ মাসুদ ফরহাদের ‘জলের ফুল’ কবিতার বইটি আপনি বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করতেই পারেন। তবে বইটিতে ভালোবাসার ও ভালোবাসা পাওয়ার আকুলিত প্রার্থনা মূলত; সেখান থেকে নড়ার কবি নন রাজ মাসুদ ফরহাদ, সেজন্যই বলেছেন বুঝি—
জলের গভীরে ফোটে নিঃশব্দ ফুল,
যেন হারিয়ে যাওয়া শব্দের দীর্ঘশ্বাস,
যেন নক্ষত্রহীন আকাশে একাকী প্রদীপ—
নিভে যেতে যেতে জ্বলে,
জ্বলে উঠতে উঠতে হারায়।
কার ইশারাতে ভাঙে জলের তরঙ্গ?
কে সাজায় ছায়ার অলীক পটভূমি?
(জলের ফুল, পৃষ্ঠা-৮৬)
রাজ মাসুদ ফরহাদ—যার জন্য অশ্রু ঝরে; তার জন্যই নিজের সেই অশ্রুর প্রবাহে ফুল ফোটাতে পারেন। কবি তো এমনই...
বই: জলের ফুল
কবি: রাজ মাসুদ ফরহাদ
প্রকাশনী: প্রতিকথা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
মূল্য: ২৮০ টাকা।
এসইউ/জিকেএস