ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সমগ্র কবিতা

আবু আফজাল সালেহ | প্রকাশিত: ০৪:১৬ পিএম, ২৭ মে ২০২৫

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯ সেপ্টেম্বর ১৯০৩-২৯ জানুয়ারি ১৯৭৬) কল্লোল যুগের অন্যতম প্রভাবশালী কবি। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই আটটি। অমাবস্যা (১৯৩০), আমরা (১৯৩২), প্রিয়া ও পৃথিবী (১৯৩৩), নীল আকাশ (১৯৪৯), আজন্ম সুরভি (১৯৬৫), পূর্ব-পশ্চিম (১৯৬৯), উত্তরায়ণ (১৯৭৪) এবং অচিন্ত্যকুমারের সমগ্র কবিতা (১৯৭৪)। ১৯২৫ সালে তিনি কল্লোল প্রকাশনায় জড়িত হন। বিচিত্রায়ও কিছুদিন কাজ করেন। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে সমাজের নানা দিক। তিনি রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে সৃষ্টি করতে পেরেছেন নতুন স্বর। সব বিষয়ই উঠে এসেছে কবিতায়। সমসাময়িক থেকে হয়েছেন চিরকালীন। শুধু ভাষায়ই পরিবর্তন আনেননি; এনেছেন ভাবের পরিবর্তন। ভাব ও ভাষায় নতুনত্ব আনতে বিদ্রোহ করেছেন। প্রথমদিকের লেখায় ফ্রয়েডীয় অবচেতনবাদ উঠে এসেছে। জীবনের ঘেরাটোপ ভেঙে নতুন জীবনের সূচনা করতে চেয়েছেন; যার বড় একটি অংশই যৌনতা ও উদ্দামতা। ইউরোপীয় স্টাইল আনতে চেয়েছেন লেখা ও জীবনে। এজন্য তাঁকে অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে।

কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আদিবাড়ি মাদারীপুরে। পরে কলকাতায় স্থায়ী হন। মারা যান কলকাতাতেই। মনেপ্রাণে বাংলাদেশকে ভুলে যেতে পারেননি। তাঁর মনোভাব প্রকাশিত হয় ‘পূর্ব-পশ্চিম’ কবিতায়। ‘তোমার শীতলক্ষ্যা আর আমার ময়ূরাক্ষী/ তোমার ভৈরব আর আমার রূপনারায়ণ/ তোমার কর্ণফুলি আর আমার শিলাবতী/ তোমার পায়রা আর আমার পিয়ালী/ এক জল এক ঢেউ এক ধারা/ একই শীতল অতল অবগাহন, শুভদায়িনী শান্তি।/ তোমার চোখের আকাশের রোদ আমার চোখের উঠোনে এসে পড়ে/ তোমার ভাবনার বাতাস আমার ভাবনার বাগানে ফুল ফোটায়।/ ...আমরা এক বৃন্তে দুই ফুল, এক মাঠে দুই ফসল/ আমাদের খাঁচার ভিতরে একই অচিন পাখির আনাগোনা।/ আমার দেবতার থানে তুমি বটের ঝুরিতে সুতো বাঁধো/ আমি তোমার পীরের দরগায় চেরাগ জ্বালি।/ আমার স্তোত্রপাঠ তোমাকে ডাকে/ তোমার আজান আমাকে খুঁজে বেড়ায়।/ ...আমাদের এক রবীন্দ্রনাথ এক নজরুল।/ আমরা ভাষায় এক ভালোবাসায় এক মানবতায় এক/ বিনা সুতোয় রাখীবন্ধনের কারিগর/ আমরাই একে অন্যের হৃদয়ের অনুবাদ/ মর্মের মধুকর, মঙ্গলের দূত/আমরাই চিরন্তন কুশলসাধক।’ (পূর্ব-পশ্চিম)

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, গান্ধী, শরৎ চন্দ্র, জওহরাল নেহরু, জলধর সেন, জীবনানন্দ দাশ, চিত্তরঞ্জন, শিশিরকুমার ভাদুড়ি, অরুন্ধুতী রায় প্রমুখের ওপর কবিতা লিখেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ও ভারতের বন্ধু ফরাসি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রম্যাঁ রলাঁকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন। আজন্ম সুরভি, নীল আকাশ ও পূর্ব-পশ্চিম কাব্যগ্রন্থে এমন কবিতা পাওয়া যায়। কবি-লেখক-নেতার প্রতি কবিতায় এমন আধিক্য দেখা যায় না বললেই চলে। কেউ কেউ একজন বা দুজন ব্যক্তিত্ব নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। তিনি বেশকিছু শ্রেণিপেশার ব্যক্তিত্ব বা কর্ম নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কীর্তিমানদের নামেই কবিতার শিরোনাম করেছেন। ব্যতিক্রমী আয়োজনে অচিন্ত্যের উদারতার পরিচয় মেলে।

১. বিলাসের স্তব নহে, রচিয়াছ বেদনার বেদ,/ হে সৌম্য সন্নাসী, তুমি গাহিলে সাম্যের সাম গান!/ নর-নারায়ণে তুমি হেরিয়াছ অখণ্ড অভেদ/ কলহের হলাহল ফেলি কর শান্তি-সোম-পান। (রম্যাঁ রলাঁ)
২. আমি আজো দেখি নাই সাহাজাহান যে গড়িয়াছে তাজমহল/ আমি শুধু পড়িয়াছি তোমার কবিতা,/ আমার কল্পনাবধু তাই আজি উচ্ছ্বসিত উদ্দাম চঞ্চল/ অনবগুণ্ঠিতা! (রবীন্দ্রনাথ)
৩. চারিদিকে রূঢ় রৌদ্র রুদ্ধশ্বাস প্রখর প্রহর/ ঘূর্ণ্যমান দিন-রাত্রি ম্রিয়মাণ মুহূর্তের ভিড়/ তার মাঝে দেখিলাম শ্যামসৌম্য স্নিগ্ধ জলধর/ পূর্ণতা-প্রশান্ত-কান্তি, উদ্বেলিত, উদ্বাস্তু গম্ভীর। (জলধর সেন)
৪. শ্রদ্ধার অঞ্জলি দিব দূর হতে-এই ভেবে ধরিনু লেখনী/ নিরানন্দ, ছন্দোহীন: অকস্মাৎ দুয়ারে কাহার করধ্বনু!/ কে আসিল বর্ষাশেষে, ভাদ্রের সংক্রান্তি-লগ্নে,-খুলে দিনু দ্বার,/ কি অমৃত তরঙ্গিনী! ভীরু কণ্ঠ উচ্চারিল: ‘তুমি? চমৎকার!’... (শরৎ চন্দ্র)
৫. সমস্ত বোধের শেষে আরো এক বোধ থাকে বাকি,/ তুমি শান্ত প্রাণ এক, মহান একাকী। (জীবনানন্দ)

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কবিতায় অনুপ্রাস সৃষ্টি ও অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে দারুণ সব শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টানা অন্ত্যমিলও পাওয়া যায়। অনেক কবিতার ক্ষেত্রে ছোট ছোট চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। সে ক্ষেত্রে ছোট্ট ছোট্ট চিত্রকল্প মিলিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে সক্ষম হয়েছেন। আধুনিককালে অনেক কবিই ছোট ছোট চিত্রকল্পের মাধ্যমে পূর্ণ অবয়ব দিচ্ছেন। কয়েকটি অংশ তুলে ধরি-
• এতদিন ছিলাম তুমি আর আমি, এবার আমরা:/ এবার দুজন।/ আবার বেঁধেছি গাঁটছড়া/ প্রতিরোধের সঙ্গে আক্রমণ।/ দেখেছি অনেক কেলিকলা/ স্খলিত মেঘলা;/ ছুঁয়েছি অনেক ত্বক/ আপাদমস্তক;/ নিয়েছি অনেক ঘ্রাণ/ শিহরায়মান।/ মুখরস্থিত/ আহা, চুম্বনটি ছিল মনোনীত! (প্রতিবাসী)
• আজি সব পাতাঝরা,/ ছেঁড়া যত গাঁটছড়া,/ পাখিসব বাসাহারা, ছিন্ন মালঞ্চ... (চন্দ)
• কোথা তুমি আছ কবি/ কল্পনা-গরবী,/ অনাগত যুগের সম্রাট/ হে বিরাট (অনাগত কবি)
• মিলনের রাতে উঠানের কোণে জ্বলিছে বিরহ-বাতি,/ জ্যৈষ্ঠের রোদে কপাল ফুটিছে অমাবস্যার রাতি।/ তোমার হাসির পিছে/ প্রতিবেশিনীর নিবানো দ্বীপের বেদনা নিঃশ্বসিছে। (মিলনের রাতে)

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

অচিন্ত্যকুমার উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন। আশেপাশের থেকে শুরু করে দূরদেশের উপদান ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। যেমন-
১. দিগন্তে অরণ্য যদি/ আকাশের প্রেমে পায় ব্যাপ্তি আর সীমা,/ আকাশ আর বনানী হয়/ শ্যামলের বুকে নেয় প্রশান্ত নীলিমা। (নীলিমা)
২. ওগো প্রিয়া,/ শ্যামলিয়া,/ মরি মরি,/ অপরূপ আকাশেরে কি বিস্ময়ে রাখিয়াছ ধরি (বিরহ)
৩. এ মোর একার গর্ব আজি এ নিখিলে,-/ তুমি যাহা নও,- তাই, তাই তুমি মোর কাছে ছিলে।/ এ মোর একার অহঙ্কার- (নারী)
৪. কত শত জোয়ানের রক্ত খেল পিশাচ রাক্ষস/ কত ঘরে নিয়ে এল দুঃসহ দুর্দিন,/ তা হোক তা হোক-/ তোমাদের কণ্ঠস্বর তবু যেন না হয় কর্কশ/ ব্যবহার নাহি হয় হৃদয়বিহীন,/ তা হোক তা হোক-/ ভেবে ওরা তোমাদেরি পৃথিবীর লোক।/ যদি চাও উঁচিয়ো সঙিন/ কিন্তু দেখে থেকো স্বপ্নেতে রঙিন... (তা হোক)।

বিশ্বের সবাইকে গ্রহণ করতে হবে, ভালোবাসতে হবে। স্বদেশকে ভালোবাসলেই পৃথিবীকে ভালোবাসা সম্ভব। স্বদেশ এড়িয়ে আন্তর্জাতিক-মানবতা সম্ভব নয়। কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তও তাই বলতে চেয়েছেন: ‘উত্তীর্ণ হবার দিন আরেক প্রত্যয়ে,/ আদিম প্রত্যয়ে।/ অনেক বিজ্ঞান ঘেঁটে ফিরে আসা শাশ্বত বিস্ময়ে।/ সব রঙ মুছে যায়, আকাশ অক্ষয় থাকে নিরঞ্জন নীলে,/ গাছ বাঁচে মূলে জল দিলে।/ শাখায় পল্লবে ত্বকে নয়, নয় কুসুমে মুকুলে/ জল ঢালো মাটি হতে উঠে আসা মমতার মূলে।/ ...পৃথিবীরে ভালোবাসা যায় স্বদেশের প্রথম বাসিলে। (আন্তর্জাতিক)।

সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন ধাবমান। একটুখানি বসে থাকলে পিছিয়ে পড়তে হয়। চিন্তায়ও পিছিয়ে থাকা যাবে না। সবই ঘূর্ণায়মান। চাকা বা গোলাকার জিনিসের ওপর সবকিছুই নির্ভরশীল। গতিশীল করতে চক্র বা চাকা ছাড়া সম্ভব নয়। সব গতিশীল বস্তুতে বা অনুভবে অন্তর্নিহিত চক্রফাঁদ রয়েছে। চক্র ছাড়া কোনো উপসংহার বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। অচিন্ত্যকুমারও তাই বললেন: ঊর্ধ্ব আকাশে ঘুরিছে চাকা/ আমরা পৃথিবী-পোকার পাখা,/ ঘুরিছে চাকা।/ গতি-তরঙ্গে কেহ না মূর্ত,/ দ্রুত তরঙ্গ-প্রতি মুহূর্ত,/ বিদ্যুৎ-উদ্দাম;/ উপরে মৃত্যু, নিচে সময়/ উদ্বেল সংগ্রাম। (চাকা)

বিজ্ঞাপন

‘অমাবস্যা’ অচিন্ত্যকুমারের প্রথম প্রকাশিত কাব্য। অমাবস্যা কাব্যের বেশিরভাগ জুড়ে রয়েছে হতাশা, অবিশ্বাস ও সন্দেহ।

১. মলিন দিনের মাধুরী হেরিয়া মধুর হয়েছে মন,/ রোগশয্যায় শুয়ে আছি একান্ত অকারণ।/ তবু সবি লাগে ভালো,/ বিদায়বেলায় গোধূলির চোখে মৃদু মুমূর্ষু আলো। (তবু সবি লাগে ভালো)

২. রজনীতে আর জীবনে বিরাজে বিস্তৃত স্তব্ধতা,/ শুধু মনে পড়ে তোমার মুখের মধুর মিথ্যা কথা।/ ‘ভালোবাসি’ বলেছিলে,/ নিমেষে আকাশ ভরে গিয়েছিলো নয়নভুলানো নীলে। (মধুর মিথ্যা কথা)

বিজ্ঞাপন

৩. মুকুরে বসিয়া বেণী বাঁধিতেছে, আঁচল পড়েনি খসে;/ যদি আজ যাই, নিশ্চয় চোখ ভরিবে না সন্তোষে।/ আজি তুমি কত দূরে-/ শুভকামনার প্রদীপ জ্বালিবে একদিন সিন্দুরে! (সঙ্কেতময়ী)

নানা অসঙ্গতি ও সমাজের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। ধনীর দুলাল বা বখাটের কাজও বাদ পড়েনি:

১. চল, তাড়াতাড়ি কর,/ আর দেরি নয়, বেরিয়ে পড় বেরিয়ে পড় এখুনি।/ ভোররাতের স্বপ্নভরা আদুরে ঘুমটুকু নিয়ে/ আর পাশে ফিরতে হবে না।/ উঠে পড় গা ঝাড়া দিয়ে,/ সময় নেই-/ এমন সুযোগ আর আসবে না কোন দিন। (উদ্বাস্তু)

বিজ্ঞাপন

২. ...ঐ পথ দিয়ে জরুরী দরকারে যাচ্ছিলাম ট্যাক্সি করে।/ ড্রাইভার বলে-, ‘ওদিকে যাব না।/ দেখছেন না ছন্নছাড়া ক’টা বেকার ছোকরা/ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে।/ চোঙা প্যান্ট, চোখা জুতা, রোখা মেজাজ, ঢোকা কপাল।/ ...কারা ওরা?/ চেনেন না ওদের?/ ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের/ এক নেই রাজ্যের বাসিন্দে। ওদের কিছু নেই।/ ধীত নেই, ভীত নেই, রীতি নেই, নীতি নেই,/ আইন নেই, কানুন নেই, বিনয় নেই, ভদ্রতা নেই,/ শ্লীলতা শালীনতা নেই।/ ঘেঁষবেন না ওদের কাছে। (ছন্নছাড়া)

৩. প্রতিবেশি-ঘরে আগুন লাগালে তাড়ানো যাবে বা চীন,/ এটা তো সহজ সঙ্গত কথা সভ্য ও সমীচীন।/ কে তুমি হে প্রতিবেশী/ আগ বাড়িয়ে কিছু বলছ না কিছু বেশি?/ চোরের মায়েরই হয় জানি বড় গলা,/ ঠাকুরঘরে কে, শুধালেই বলে, আমি তো খাইনি কলা (প্রতিবেশী)।

জীবন-মৃত্যু, রুম-ফুটপাত, বিত্ত-দারিদ্র্য, কামনা-বাসনা সব কিছুকেই এক কলমে ধরেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। ভিন্ন দুই জগত, দুরকম ভাবনা, নিজের লেখার ভেতরে ধারণ করতে পেরেছেন। এই দুর্লভ গুণই তাঁকে করে তুলেছিল স্বতন্ত্র। তাই তো সমসাময়িক হয়েও চিরকালীন তিনি। চিরকালীন তার কবিতার চরণ।

বিজ্ঞাপন

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন