বই আলোচনা
মধুর বিরহ: আত্মোপলব্ধি ও আধুনিক প্রেমচেতনা

জিয়াউদ্দিন লিটন
আধুনিক বাংলা কাব্যভুবনে কবি নাসির সিরাজীর ‘মধুর বিরহ’ কাব্যগ্রন্থটি একটি অনন্য সংযোজন। প্রেম, বিরহ, আত্মসন্ধান, লোকজ দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা—এ সমস্ত উপাদানকে একত্রে ধারণ করে তিনি সৃষ্টি করেছেন এক অন্তরালিক কাব্যজগত। এ গ্রন্থে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক নিছক রোমান্টিক নয় বরং একটি আধ্যাত্মিক অভিযাত্রা। ‘মধুর’ এ বিরহ একাধারে দহন, আবার মুক্তির পথ আর প্রতিটি কবিতা একেকটি ধ্যানচর্চার কাব্যিক আখ্যান। এ গ্রন্থের কবিতাগুলোর ভাষা আবেগময়, প্রতীক।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
কবিতাগ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠাতেই স্থান পেয়েছে আত্মিক পথহানির গীতিকবিতা ‘নাবিক’। কবিতাটি আক্ষরিক অর্থে পথহারা নাবিকের কথা বললেও প্রকৃত অর্থে এটি এক অন্তর্জাগতিক আত্মসন্ধানের কবিতা। ‘অশান্ত ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সময় এখন/ কৃষ্ণ কবরীর মতো গভীর তিমির রাত/ নাবিক হারায় তার পথ।’ পঙ্ক্তিগুলো মানবজীবনের দুঃসময়, বিশ্বাসহীনতা ও গভীর অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতীক। ‘নাবিক’ এখানে প্রতীক হয়ে উঠেছে আত্মিকভাবে পথহারা মানুষের। কবি ‘প্রকৃতি’র আশ্রয়ে পাঠককে নিয়ে যান প্রকৃত অর্থে জ্ঞান, মুক্তি ও আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের পথে। শেষ পর্যন্ত কবির এ স্বীকারোক্তি: ‘আমি শিশু হলাম/ আমি ঋষি হলাম/ আমি নাবিক হলাম/ আমি আমার আদি ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম।’
প্রেম থেকে পরমতত্ত্বে উত্তরণের কবিতা ‘বসুধা’। এটি একটি প্রেমিক-কেন্দ্রিক কবিতা মনে হলেও বাস্তবিক অর্থে এটি প্রেমের মাধ্যমে এক আধ্যাত্মিক উপলব্ধির চূড়ান্ত প্রকাশ। স্মৃতি, বিরহ, প্রেমিকের আত্মত্যাগ ও পরিশেষে ঈশ্বরতুল্য ‘বসুধা’র প্রতি আত্মসমর্পণ কবিতাটিকে এক আলাদা মাত্রা দিয়েছে। ‘দুঃখ দুঃখ সুরগুলো সব আমারই থাক/ সুখ সুখ শিহরণ তোমার আঁচলেই থাক’—এ চরণে কবির নিঃস্বার্থ ত্যাগ প্রেমকে এক পরিশুদ্ধ বোধে পরিণত করেছে। কবিতার শেষভাগে বসুধা হয়ে ওঠেন ঈশ্বরের প্রতীক, যাঁকে উপলব্ধি করা গেলেও ধরা যায় না। স্মৃতি, সময় ও নৈঃশব্দ্যের প্রেমানুভব নিয়ে রচিত ‘ভালোবাসি’ কবিতাটি সময়ের গর্ভে ডুবে যাওয়া প্রেমের এক নিঃশব্দ দলিল। কবিতায় প্রেম বাস্তবতার অংশ নয় বরং এক স্মৃতিবদ্ধ নৈঃশব্দ্য। ‘আর কখনো আসবে না ফিরে সেই দিন, সেই মধুক্ষণ’—এ পঙ্ক্তিতে সময়কে একটি সক্রিয় চরিত্র করে প্রেমের অচলায়তনকে স্পষ্ট করা হয়েছে। ‘সখিনা’ এখানে একজন প্রেয়সী নন বরং এক অনুপস্থিত চেতনা—যিনি না থেকেও প্রতিটি চরণে রয়েছেন। কবিতাটি ধ্বনিমুক্ত এক অন্তর্জগতের প্রেমচিত্র।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
আত্মত্যাগ ও প্রেমিকার বিকাশে বিলীন হয়ে যাওয়ার কাব্যিক কাহিনির প্রকাশ ‘নীলজল’। কবিতাটি প্রেমিকের আত্মসহিষ্ণুতা—প্রেমিকার বিকাশে নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার এক নিঃশব্দ উপাখ্যান। ‘আমার শরীর চুষে চুষে তুমি হৃষ্ট হও, পুষ্ট হও রূপ-লাবণ্যে/ সোনালি হয়ে ওঠো তুমি’—এ চরণে প্রেমিক হয়ে উঠেছেন প্রেরণার উৎস, অথচ নিজেই অচেনা থেকে যান। প্রেমিকার জন্য আত্মপরিচয় বিসর্জন দিয়েও তিনি আক্ষেপ করেন না। ‘পথিক আজ চেনে না আমায়, চেনে শুধু তোমায়’—এ প্রেম আত্মত্যাগের, বর্জনের ও আত্মবিসর্জনের এক নিঃশব্দ জয়গান। ক্ষয়ের ভেতরেও আশার আলোকদ্যুতির চমৎকার কবিতা।
কবির আধ্যাত্মিক প্রত্যয়ের নিদর্শন ‘তবুও স্বপ্ন দেখি’। কবিতাটিতে সমাজ, রাজনীতি, ক্লান্তি, হাহাকার—সবকিছুর মাঝেও কবি স্বপ্ন দেখেন। ‘অশ্রুকণা রক্তের ফোঁটা হয়ে ঝরে’—এ চিত্রকল্পে দুঃখের শারীরিক রূপায়ণ ঘটানো হয়েছে। ‘থাকে শুধু প্রতীক্ষা ক্লান্ত, প্রতিশ্রুতি ক্লান্ত’—কবিতাটি ক্লান্ত আশার ভেতরেও এক অন্তর্জাগতিক প্রত্যয়ের কণ্ঠস্বর তুলে ধরে। এটি শুধু কাব্য নয়, একটি সামাজিক নীতিজাগরণও।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
লোকজ দর্শনে আধ্যাত্মিক জার্নি বলতে যা বোঝায়, তা হলো ‘মাটির তরি’। কবিতাটি বাংলা আধ্যাত্মিক কবিতার পরিসরে এক অনন্য সংযোজন। এটি কেবল একটি ধর্মীয় ভাবনা নয় বরং লোকজ উপমা, প্রতীক ও দর্শনসমৃদ্ধ কাব্যনির্মাণ; যা আত্মিক সচেতনতা, নৈতিক মূল্যবোধ ও তাওহীদিক আকিদাকে একসূত্রে গেঁথে পাঠকের সামনে মেলে ধরে। এ গবেষণায় কবিতাটির প্রতিটি স্তবকের প্রতীকী ব্যঞ্জনা, আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এবং সাহিত্যিক সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করা হবে। কবিতার কেন্দ্রবিন্দু ‘তরি’ বা নৌকা। এটি মানবজীবনের প্রতীক—যা ভঙ্গুর, মাটির তৈরি এবং সহজেই দিগ্ভ্রান্ত হতে পারে। কবি ‘নয়খানা ছিদ্র’ দ্বারা মানুষের নয়টি ইন্দ্রিয় বা আত্মিক প্রবেশপথকে বোঝান, যেগুলো সংযমহীন হলে জীবন-তরিকে ডুবিয়ে দিতে পারে। এ নয়টি ছিদ্র হলো: দুই চোখ, দুই কান, দুই নাকের ছিদ্র, মুখ, গোপনাঙ্গ, মলদ্বার। এ প্রবেশপথগুলোর মাধ্যমে দুনিয়ার মোহ, লালসা, পাপ ও বিভ্রান্তি মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে, যদি এগুলোর ওপর আত্মিক নিয়ন্ত্রণ না থাকে। ‘ছয় ঘাটের ছয়জন’ হলো ষড়রিপুর প্রতীক—মানবজীবনের ষড়ভ্রান্তি। ছয়টি রিপু বা অন্তর্জাত শত্রু হলো: কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য, অহংকার। ছয়টি রিপু মানুষের মন ও অন্তরকে বিভ্রান্ত করে আত্মিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। কবিতায় স্পষ্টভাবে আল্লাহর একত্ব (লা-শারিক আল্লাহ) এবং তাঁর রাসুলের (সা.) প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। এটি কবিতাকে একটি দাওয়াতুল হক বা ঈমানি জাগরণের কাব্যে রূপ দিয়েছে। আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর পথেই পরিত্রাণ—এ বার্তা কবি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। শেষ স্তবকে কবি কেয়ামতের দৃষ্টান্ত টানেন: ‘তরিখানি তোর গেছে ভরে, নাই কিছু আর বাকি।’ এ বাক্য কেবল মৃত্যুর বার্তা নয়, এটি সময় ফুরিয়ে আসার, জীবনকে আত্মিকভাবে ভরাট করার তাগিদ। এটি নিতান্ত কোনো ভীতির সঞ্চার নয় বরং আত্মজিজ্ঞাসার পথ খুলে দেয়। ‘মাটির তরি’ কবিতাটি বাংলা কবিতায় প্রতীকবাদ, আধ্যাত্মিকতা এবং লোকধর্মিতার সমন্বয়ে একটি দৃষ্টান্তমূলক সৃষ্টি। এর ভাষা, ভাব, বর্ণনা ও বার্তা—সব মিলিয়ে এটি আত্মদর্শনের কবিতা। বাংলা সাহিত্যের ধর্মভিত্তিক আধ্যাত্মিক কবিতার ধারায় এটি একটি মূল্যবান সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
কবিতা গ্রন্থের শিরোনাম এবং আত্মদর্শনের চূড়ান্ত উপলব্ধি ‘মধুর বিরহ’—একটি আধ্যাত্মিক ভ্রমণকাব্য। এখানে বিরহ প্রেমিক-প্রেমিকার নয়, আত্মা ও পরমাত্মার মাঝের মধুর বেদনা। কবিতার প্রতিটি চরণ প্রতীকে পূর্ণ—‘মাটির পুতুল’, ‘জাঁতা পেষা’, ‘মহাসমুদ্র’, ‘সিনার জল’। ‘জাঁতা পেষার শব্দের মতো গভীর হতে আসে ভেসে’—এ চরণ আত্মার ভেতরের ঘর্ষণের প্রতীক।
লেবাননের দার্শনিক-প্রেমিক কবি, যিনি ‘দ্য প্রোফেট’ ও ‘ব্রোকেন উইংস’-এ প্রেমকে বিশুদ্ধ আত্মিক বন্ধন হিসেবে দেখিয়েছেন। নাসির সিরাজীর ‘মধুর বিরহ’তে ঠিক সে রকমই এক তীব্র আত্মিক প্রেম, যা শারীরিক নয়, আত্মা ও পরমাত্মার মাঝে গোপন আকর্ষণ। উভয় কবির ভাষায় একইভাবে বিরহ, নৈঃশব্দ্য ও প্রেমের মধ্যে ঈশ্বরের অভিজ্ঞান ধরা দেয়। খালিল জিবরান:
‘Ever has it been that love knows not its own depth until the hour of separation.’ ‘কালামুল্লাহর অনুরাগে-ভয়ে অন্তর গলে’—এ উপলব্ধি একমাত্র আধ্যাত্মিক আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই সম্ভব। এটি কেবল একটি কবিতা নয় বরং আত্মোপলব্ধির এক পরম আহ্বান।
বিজ্ঞাপন
কবি নাসির সিরাজীর ‘মাটির তরি’, ‘মধুর বিরহ’ বা ‘নাবিক’ কবিতাগুলোর ভেতরে লালন ফকিরের আত্মদর্শন, দেহতত্ত্ব ও সাধনভিত্তিক বাউল ধারা প্রতিধ্বনিত হয়। লালনের মতো সিরাজীর কবিতায় দেহ-প্রকৃতিকে নৌকা, পুতুল বা তরি হিসেবে তুলে ধরা হয়, যার মাঝখানে নয়টি ছিদ্র, যেগুলোর নিয়ন্ত্রণে আত্মা সফলতা লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ:
লালনের—‘এ দেহেরে জানলে শুদ্ধ/ মনেরে জানবি রে।’
নাসির সিরাজীর—‘ছিদ্র যদি বেঁহুশ থাকে/ ডুববে তোমার নাওখানা।’
কবি নাসির সিরাজীর কাব্যগ্রন্থটি প্রেম, আত্মত্যাগ, লোকজ দর্শন ও আধ্যাত্মিক সাধনার মিলনস্থল। প্রতিটি কবিতা ভাবগম্ভীর, প্রতীকসমৃদ্ধ, আত্মবিশ্লেষণধর্মী এবং সাহিত্যিক উৎকর্ষে ভরপুর। নাসির সিরাজীর ভাষা সহজ, গ্রামীণ এবং লোকসাহিত্যের আবহে গঠিত। এতে একদিকে যেমন গ্রামীণ পাঠকের নাগাল আছে, অন্যদিকে দার্শনিক গভীরতাও রয়ে গেছে। প্রতিটি স্তবকে ছন্দ, অন্ত্যমিল ও সুরের ভঙ্গিমায় পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। বাংলা কবিতার ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, যা আধুনিক পাঠকের কাছে প্রেম এবং মুক্তির মধ্যবর্তী একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে। এ গ্রন্থকে নিছক রোমান্টিক কবিতা হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এটি আত্মানুসন্ধানের এক কাব্যিক দলিল, যেখান থেকে জন্ম নেয় ‘মধুর’ এক ‘বিরহ’—যা আত্মাকে করে পরিশুদ্ধ, বিশুদ্ধ ও মুক্ত।
বিশ্লেষক: সাবেক অধ্যক্ষ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিজ্ঞাপন
এসইউ/এমএস
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন