ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

বই আলোচনা

শূন্য রথের ঘোড়া: হৃদয়ে গেঁথে থাকা উপাখ্যান

মাহমুদ নোমান | প্রকাশিত: ০৫:২৭ পিএম, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভাষাকে বাজিয়ে দিতে পারার মহৎপ্রাণের শিল্পিত কর্ম মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্য। উপমা কিংবা ঠেস কথার মাধুর্যে হেলা করার জো নেই। বরং আলাদাভাবে দাঁড়িয়ে যায় বুক টান করে। নতুনতর শব্দ-যোগে তাৎপর্যপূর্ণ দ্যোতনা সৃজন, মার্জিত উপমার শরীরে টান টান রহস্য এখনকার কথাসাহিত্যকে প্রতিনিধিত্ব করে। তার ‘শূন্য রথের ঘোড়া’ উপন্যাস পাঠে এসব সত্যের মুখোমুখি হয়ে তাকে মার্কিং করে বৈভবশালী বৈঠকের উপস্থাপনার দাবি রাখে। উপন্যাসটি পড়ার মধ্যে তার কথাসাহিত্যের দম বুঝতে সক্ষম হবেন।

মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্যের বয়ন কৌশল বিষয় আঙ্গিকের অতল স্পর্শে বহুবিধ স্পর্শ জাগানিয়া প্রবণতায় বৃহৎ কলেবর সুসংগঠিত করতে পারে। একটি ঘটনা বোঝাতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে আরও অনেক ঘটনার বর্ণনা এক পরিবেশের সাথে অনেক পরিবেশের সম্মিলন। এসব বর্ণনা হয়তো বেশি ঝুঁকির। কেননা খেই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মঈনুল হাসান এসব ঝুঁকি বেশ উপভোগ করে লিখতে পারেন। তার কথাসাহিত্যের বহর এমন সুবিশালে সুবিন্যস্ত, সেখানে পাঠকের কাছে সু-ধীর ভেদবুদ্ধি চেয়ে নিতে পারে। নয়তো রসহীন মনে হতে পারে! আদতে তার কথাসাহিত্যের দাপট কিংবা নিজস্ব জগতে তিনি অবিচল এবং দক্ষ কারিগর।

মঈনুল হাসানের কথাসাহিত্য আলাদাভাবে উল্লেখের বিষয়। প্রকাশভঙ্গির বৈচিত্র্য সিনেমাটিক রোল প্লে করে। দৃশ্য থেকে দৃশ্যের যে স্তর, মনে হয় একটি কালজয়ী সিনেমার দৃশ্যবন্দি উপন্যাসটি। ভাষার দক্ষতার চেয়ে বলতে হয়, উপন্যাস লেখার মধ্যে যে শ্রম সাধ্যের সাধিত চাওয়া; সেটি তুলে ধরে। তার মধ্যে এখনকার মতো খামখেয়ালি কিংবা দেখিয়ে দেওয়ার হাপিত্যেশ, সহজভাবে বললে শর্টকাট পদ্ধতিতে জনপ্রিয়তার মোহ পাবেন না। একজন বড় লেখক হওয়ার সমূহ খাসলত তার লেখার মধ্যে পাবেন।

‘শূন্য রথের ঘোড়া’ উপন্যাসটি আমার কাছে বিশেষ হওয়ার কারণ, বেশ বড় পরিসরের উপন্যাস হওয়া সত্ত্বেও আমার মধ্যে কোনো বিরক্তিকর ভাব উদ্ভব হয়নি। আমি বাক্য থেকে বাক্যে শুধু নয়, শব্দের খেলাও উপভোগ করেছি। হালআমলে যখন উপন্যাসের নামে কয়েক পাতা পড়তেই হাঁপিয়ে উঠি। হয়তো মুখের খাতিরে কয়েক লাইনের মতামতও রাখি। কিন্তু মঈনুল হাসানের উপন্যাসটি এখনকার বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলা ও মানুষজনের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের ঠিকঠাক উপস্থাপন। সহজাত উপমার সারল্যে তরতাজা প্রাণের আকুতি পুরো উপন্যাসে। আমিও যেন প্রতিটি চরিত্রের সাথে মেহেরপুরের সীমান্তে সরল মনে জড়িয়ে পড়েছি।

উপন্যাসের প্রথমের কয়েক অধ্যায়ে খানিক দ্বিধার কোলে বসে ছিলাম। মূল চরিত্র কে এবং ঔপন্যাসিকের ভাব-গতিক অবস্থা নিরূপণ করতে পারছিলাম না। শুরুতে জয়নগর হাটের টুকু মুন্সির আড়তে আগুন লাগা নিয়ে। সেই আড়তে ইয়াসিন শেখ নামের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ বলতে গেলে সংসারহারা ওই আড়তের মধ্যে বিছানা পেতেছিলেন। ইয়াসিন শেখ নিজ বাসভূম হরিরামপুর ছেড়ে জয়নগর এসেছেন। ইয়াসিন শেখ নৌকার মধ্যে বসে ঘাটে এই হতাশা ব্যক্ত করছেন সুলেখাকে। সুলেখাও হরিরামপুর থেকে বিতাড়িত হয়ে জয়নগর হাটের লাগোয়া নদীর বিপরীতে আখড়ায় বসতি স্থাপন করেছে। সন্ন্যাসী জীবন বলা যায়।

শুরুতে সুলেখার অল্পবয়সী শরীর ও মনের বিচলন জানা যাবে। এরমধ্যে জয়নগরের পাশে ঝাঁঝা গ্রামের উপস্থিতি। ঝাঁঝা গ্রামের দিনুর বটতলা। দিনুর বটতলায় ললিতের চায়ের টং দোকান। টং দোকানের পাশে শম্ভুর কামারশালা। কামারশালার পাশে নেয়ামতের ভাতঘর। একসময় ললিতকে উপন্যাসের মূল চরিত্র ভেবেছি। এরপর সেখানে এল ফণীচাঁদ। ফণীচাঁদও হরিরামপুর ধনসামতি বিল ছেড়ে নতুন করে ঝাঁঝা গ্রামে পিসি অক্ষরীবালার ভিটেয় বসতি গড়ে তোলার বর্ণনায় উপন্যাসে উপস্থিত। দিনুর বটতলায় ললিতের টং দোকানের কাস্টমার হয়ে বসার সুবাদে ললিতের সাথে খাতির জমানো। এদিকে ললিতও বউ বীণাকে হারিয়েছে। ফণীচাঁদও হরিরামপুরে থাকতে স্ত্রী বিমলাকে হারিয়ে এসেছে। স্ত্রী বিমলার স্মৃতি বলতে ছেলে নবীন আর নন্দ। ললিত কিংবা ফণীচাঁদ দুজন দুজনকে বুঝতে পারে বোধহয় নিজেদের কষ্ট উপলব্ধি থেকে। এ জন্যই দুজনের বন্ধুত্ব হতে তেমন সময়ক্ষেপণ হয়নি।

ফণীচাঁদ হরিরামপুর থাকতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছে। হঠাৎ ঝাঁঝায় এসে বেগতিক অবস্থা। ঝাঁঝায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করবে সেই সুযোগ নেই। পেশা পরিবর্তন করতে হবে নির্ঘাত। এদিকে পিসি অক্ষরীবালার ভিটেয় ঘর তুলতে ফণীচাঁদের অসহায় হয়ে মানুষের কাছে সাহায্য প্রার্থনা। একদিন দিনুর বটতলায় ললিতের টং দোকানে ধনু শেখের সাথে এই নিয়ে আলাপ। ধনু শেখ একজন কবিরাজ। ইয়াসিন শেখের ছোটভাই। হরিরামপুরে বাড়ি। মেহেরপুর জেলার আঞ্চলিক ভাষায় উপন্যাসের আলাদা পরিবেশ গড়ে দিয়েছে। ধনু শেখের নাম হয়ে গেল ধনু শেখ কোবরেজ। ফণীচাঁদের জন্য একটি কাজ জোগাড় যেমন জরুরি; তেমনই থাকার ঘর তোলা আবশ্যক। ধনু শেখ ঝাঁঝার খড়িডোবা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খেদের আলী চেয়ারম্যানের কাছে সাহায্য চাওয়ার বুদ্ধি দেন। চেয়ারম্যানের সুনজরে এলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলেন। এ ক্ষেত্রে ফণীচাঁদ ও ধনু শেখ কোবরেজের আলাপ উল্লেখ করছি, ‘আমায় যদি ফিরি দেয় কোবরেজ? তুমি তো জানো, আমি ঠিক মতন গুইছি কিছু বুইলতি পারি না। তুমি যদি সঙ্গে ইকদিন যেতে?

আমারে নিয়ি খামোখা টানাটানি কইরো না। নিজের কুথা মুখ ফুইটি বুইলতি না পারলি ই জগতে বেঁচি থাকা যায় না। সমস্ত মানুষই নিজের জন্যি একা। রথ দেখিছু কখনো? মানুষ বা জন্তু ছাড়া শূন্য রথ? মানুষ না থাকলি সিই রথ শূন্য হয়ি পইড়ি থাকে। সিই রথ টানার জন্যি ঘোড়াও লাগে। আবার উলটোখানও ভেইবি দ্যাখো। মানুষ আছে ঠিক কিন্তু রথখানাই ন্যাই। রথ একদিকে আর তারে চালানোর মানুষটা অইন্যদিকে। যে যার মতন একা। কুনো লাভ ন্যাইকো। মানুষের ইচ্ছেখান হলু সিই শূন্য রথের ঘোড়া। সিই প্রবল ইচ্ছে রথখানও চালাবে আর মানুষটারে নিয়ে নিজেও হেঁটি যাবে। বুইঝলে ফণী, নিজের রথ নিজে টেনি নিতে না পাইরলি গন্তব্যে পৌঁছা যায় না কুনোদিন।’ (পৃ-৪৬)

আরও পড়ুন

উপন্যাসের নাম কেন ‘শূন্য রথের ঘোড়া’ সেটি বোঝানোর জন্য খোলাসা করতে চেয়েছেন কয়েকবার এমন ভাবনার কথোপকথনে। এটি সরাসরি না বললেও উপন্যাসটি পড়া শেষে পাঠকমাত্রই বুঝতেন, কেন ‘শূন্য রথের ঘোড়া’। মঈনুল হাসান মারপ্যাঁচ রাখেন না, মাটির মানুষের সংস্পর্শে কথাসাহিত্য সাজিয়ে তুলেছেন। ফণীচাঁদের ঘর তোলা হয়েছে, এমনকি চেয়্যারম্যানের অনুগ্রহে কাজও জুটেছে সীমান্ত চৌকির ক্যাম্পে কমান্ডার শেখ আজমলের বদৌলতে। ফণীচাঁদের বড় ছেলে নবীনকে সীমান্তের ওপারে হাঁসডাঙায় পাঠানো হয় কাজের সন্ধানে। সেখানে থাকেন ফণীচাঁদের বাবা কানু মণ্ডলের বড়ভাই ভাদু মণ্ডল। কিন্তু কখনো দেখা হয়নি। পিসি তাঁর ভাই ভাদু মণ্ডলের জন্য চিঠি লিখে দেয় নবীনের হাতে। নবীনকে সীমান্ত পার করে নিয়ে আবার ফিরে চারণ বাগদি। চারণ বাগদি বৃদ্ধ মানুষটি এসব করে, কেননা পিসির স্বামী মারা যাওয়ার পরে স্বামীর দোকানটি উনাকে দিয়ে দেয়।

মানুষ মানুষের জন্য, বিভিন্ন কারণে আশপাশের সবকিছু সময়ে অসময়ে কেউ ফেলনা নয়; এটিকে উপজীব্য করে উঁচিয়ে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। নবীনকে সীমান্ত পার করার আগে সুলেখা ও ফণীচাঁদের এক অমর প্রেমের কথা জানবে পাঠক। একদিন বিকেলের দিকে দিনুর বটতলায় ললিতের টং দোকানে আড্ডার একপর্যায়ে ললিতকে বলে জয়নগর হাটে যাবে পিসির জন্য সাদা থানের কাপড় কিনতে। কাপড়ের দোকানে গিয়ে সাদা থানের সাথে লাল-সবুজের ডুরে একটা কাপড় যখন কেনে ললিতের বুঝতে আর বাকি রইলো না। ললিতের মুচকি হাসি, ললিত সব জানে, দোস্ত বলেই সব জানে। সেই লাল-সবুজের শাড়ি নিয়ে সুলেখার কাছে যাওয়ার মুহূর্ত পাঠককে বিচলিত করবে। শ্যামলাল দাসের কাপড়ের দোকানে গিয়ে শাড়িটি কেনার সেই মুহূর্তে ফণীচাঁদের ভাবনা, ‘থান দেখতে দেখতে লালপাড় দেওয়া একটা কলাপাতা রং শাড়ি খুব পছন্দ হয়ে গেল ফণীচাঁদের। শাড়িটা চোখে লাগার পর থেকেই চোখের সামনে সুলেখার মায়াবী মুখটা শুধু ভাসছে। অনেকদিন সুলেখাকে দেখে না ফণীচাঁদ। কিন্তু ওর মন বলছে সুলেখার শরীরে এই শাড়িটা পেঁচিয়ে উঠলে ও যেন প্রকৃতই এই কথাবলা হিরামন পাখি হয়ে উঠবে। ফণীচাঁদের মনে মনে যেন বলার ইচ্ছে, আমার সাহস হয়নিকো কুনোদিন, কিন্তু সুলেখা তুমি বড্ড সুন্দর গো। আমি ভুল কইরিছি। তুমারে ফিরি দিয়ি আমি অন্যায় কইরিছি। সিটারই মাশুল দিচ্ছি অ্যাখুন।’ (পৃ-১৫৮)

আখড়ায় সেদিন গানের আসর বসেছে। ফণীচাঁদের মনে পড়ে বৈরাগী বাবা কানু মণ্ডলের গান গাওয়ার সেসব পুরোনো কথা। সেদিন গানের আসরে সুলেখা এক ধ্যানে বিরহিণী সাদা থানে বসেছিল। সুলেখার আখড়ায় খাঁচার হিরামন পাখি ফণী ফণী করে ডেকে ওঠে। এ থেকে বোঝা যায়, আখড়ায় এই প্রথম এলেও সুলেখার সাথে প্রেম সে অনেক আগের। হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের সংযোগ আসল সেটিই নিরূপণ করে। সেদিন সুলেখার ধ্যান ভঙ্গ না করে শাড়িটি জগদীশকে দিয়ে আসে। জগদীশ মানে ডাকনাম জগা, আখড়ার দেখাশোনা করা কিংবা সেবাদাস। সুলেখাকে দিদি বলে ডাকে।

সুলেখাকে দেখেও হাতে হাতে শাড়িটা দিতে না পেরে ফণীচাঁদের মন আরও অস্থির হয়ে উঠল। আরও বেশি কিছুর বাসনা জেগেছিল বোধহয়। কী আশ্চর্য প্রেমের টান ও টিউনিং। যেদিন শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে একটু সেজে উঠল; সেদিন আবার ফণীচাঁদ এলো। এলো তো ঘর ভরিয়ে সোহাগ উপচে পড়লো। ঔপন্যাসিক এখানে রগরগে ভাষার বিপরীতে প্রকৃতির সহজাত উপমার সারল্যে এই কামনা-বাসনা পরিপূর্ণ করে দিলো। পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হয়নি নরনারীর মিলন ও মিলনসুখের বন্ধন। ফণীচাঁদ সীমান্ত চৌকির ভেতরে চাষবাসের কাজের সাথে চৌকির লাগোয়া পিসির জমিতেও সূর্যমুখীর চাষ করলো। এই যেন সুখের ভরন্ত নদী টলমল করছে কানায় কানায়। কৈশোর পার না হওয়া নন্দকে ধনু শেখ কোবরেজের কাছে কবিরাজি বিদ্যা শিখতে দিলো। এদিকে সীমান্ত এলাকায় বেশ উত্তেজনা। ঝাঁঝার মরা নদী খনন চলছে। খেদের আলী চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে চেয়ারম্যানের ভাইয়ের ছেলে মন্তাজ এসবের দেখাশোনা করে। দিনুর বটতলায় ধনু শেখ, ললিত, ফণীচাঁদ কিংবা মন্তাজ সবাই পরস্পরের দুঃখে-সুখের সাথী যেন। সীমান্তে ভুল বোঝাবুঝি বলি কিংবা শাসন শোষণের মাত্রা বলি রাজনৈতিক এই খেলা উপন্যাসে উঠে এসেছে সরেজমিনের ব্যাখ্যায়।

উপন্যাসটিতে নব্বই দশকের এক জ্বলজ্বল করা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যেন; নব্বই দশকের এক অকৃত্রিম গন্ধ ও রূপ উন্মোচিত হবে পাঠকের সামনে। প্রতিদিনের মতো সীমান্ত চৌকির কাজ সেরে সীমান্ত লাগোয়া হলুদ ফুলের সূর্যমুখী ক্ষেত ঘুরে সেদিন কেন জানি ফণীচাঁদের মাথা বিগড়ে গেছে। সহজভাবে বললে মৃত্যু ওইভাবে লেখা হয়েছে ফণীর। সেজন্য ঘুরে ঘুরে সীমান্তের বিপজ্জনক জায়গায় চলে গেল ফণী। সেই দৃশ্য উল্লেখ করছি, ‘অথচ ফণীচাঁদ তখন নিজের জমি ফেলে ডাঙার ওই জমিটার ওপর ঘুরঘুর করছে। ঘুরে ঘুরে কী যেন দেখছে। জায়গাটা অনেকখানি বিস্তৃত। ঝোঁপঝাড় সামান্য থাকলেও বেশিরভাগই সমতল আর ঘাসে আচ্ছাদিত সবুজ। সূয্যিটা ডুবে গিয়ে হালকা অন্ধকার নেমেছে ততক্ষণে। তবু পশ্চিমের আকাশে নানান রঙের ছটা খেলা করছে অদ্ভুতভাবে। চারদিকে দিনের আলো শুষে নিয়েছে অন্ধকারের সেই আবরণ। একটু পরই অন্ধকার আরও ঘন হয়ে নামবে। আর তখন আরও প্রবল হয়ে জ্বলে উঠবে সীমান্তের বাতিগুলো। কাচপোকার মতো আলোর সেই লোভে কিংবা অলীক কোনো ফাঁদে পড়ার জন্য এখন অপেক্ষা করছে ফণীচাঁদ। রোমাঞ্চে আত্মহারা ফণী যেন প্রস্তুত হয়েই আছে, এবার ও ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত। ঝোপের কাছ থেকে কোথাও ধূপ বকের ডাক উঠছে। সীমান্তের ওধারে কোথাও হিরামন পাখির দেশ। এইসব দেখে ফণীচাঁদের মোটেও ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। তাই অজানা এক ঘোরে ডুবে গিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে মাঠের ওপর চুপচাপ শুয়ে রইল ও। আজ সে আলোর অনেক কাছাকাছি, অসীম রহস্যলোক ওর হাতের একেবারে নাগালে। সেই রহস্যের ওপারেই বুঝি ডেকে ডেকে উঠছে মনের হিরামন পাখি। মাঠের জমিনে নিজেকে বিছিয়ে ক্লান্ত এক মানুষ ফণীচাঁদ অন্তরের ডাক শুনতে শুনতে ততক্ষণে বিবাগি হয়ে গেছে।’ (পৃ-২২৪ ও ২২৫)

এরূপ আচরণে ফণীচাঁদের বাবা বৈরাগী কানু মণ্ডলকে মনে করিয়ে দেয়। রক্তের মধ্যে প্রবাহিত বৈরাগ্য ধারা। মরমি চেতনাবাহী ধারাকে মেদহীন যথাযথ উপস্থাপনে ঔপন্যাসিক মঈনুল হাসানের কৃতিত্ব অনেক। চাকচিক্যের এই সময়ে লেখার মধ্যে যথার্থ মেসেজের প্রতি দায়বদ্ধতা বড় লেখক করে তোলে। এমনকি এই উপন্যাস প্রেম, মৃত্যু, উদাসীনতা, আত্মহারা ও নিপীড়িত মানুষকে উপস্থিত করে প্রকৃতির রূপরেখায়; সীমান্তে ওপারের জওয়ানের গুলিতে প্রাণ যায় ফণীচাঁদের। পীড়িত মনের দাহ হয় রাধাকান্তপুরের মাঠের শ্মশানে।

উপন্যাসে কিছু বিশেষ্যের বিশেষণ কিংবা বিশেষণের বিশেষ্য, নতুন শব্দ-বন্ধন আমাকে চমকিত করে। কয়েকটি শব্দ তন্মধ্যে- রুখো (শুষ্ক, অনেকে মনে করবে রুখে দাঁড়ানো), ধূপ (সাদা) বকের ডাক, ভুকপিয়াস (ক্ষুধা-তৃষ্ণা), চোখসহা (চোখের সহ্য হওয়া), বাতলি (মনে করিয়ে দেওয়া), ছায়াদানি (ছায়া দেওয়া), সূয্যি (সূর্য), রেডিয়োর অঁকবক, গান ভাজতে ভাজতে, ঝিনুকরূপী মানুষ; এসব বিশেষভাবে প্রভাবিত করে উপন্যাসের আঙ্গিক ও বিষয়কে। উপন্যাসে মেহেরপুর জেলার ভাষাকে যেমন আপন লেগেছে; তদুপরি সীমান্ত লাগোয়া মানুষের কথা আর আচরণের সাথে প্রকৃতি পরিবেশ আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। হয়তো একজন জাত কথাশিল্পীর এটাই নমুনা। মঈনুল হাসান একজন বড় লেখক, পাঠক এ কথা যত তাড়াতাড়ি জানবে; সেটি বাংলা সাহিত্যের জন্য মঙ্গল।

উপন্যাসের শেষের দিকে আরেক চমক দেয় সুলেখার পেটে ফণীচাঁদের সন্তান। গর্ভখালাসের দিন ফণীচাঁদের ছেলে নন্দের আখড়ায় এসেছে ললিতের সাথে। একজন নারীর গর্ভছেঁড়া ধনের পৃথিবীতে পা রাখার সময়ের বর্ণনা ঔপন্যাসিক দিয়েছেন অনন্য মাত্রায়। নন্দের দার্শনিক মনোগতিতে বাবা ফণীচাঁদের শেষ চিহ্ন যেন সুলেখার সন্তান নোটন; এ উপন্যাসকে ব্যতিক্রমী করে তোলে। ‘শূন্য রথের ঘোড়া’ উপন্যাসটি ‘নোনা মাটি ধূলিফল’ উপন্যাসের পরবর্তী আখ্যানের সংযোজন। হয়তো ফণীচাঁদের শেষ চিহ্ন নোটন আরেকটি উপন্যাসের জন্ম, নোটন কীভাবে সমাজে চোখসহা হয়, সেটিও দেখার বিষয়। ‘শূন্য রথের ঘোড়া’র পরিপূর্ণ মেসেজ মনে হয় এটাই।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন